রাজশাহীর কারাগারে ধারণক্ষমতার ৪ গুন বেশি বন্দি!

রাজশাহীর কারাগারে ধারণক্ষমতার ৪ গুন বেশি বন্দি!

বাড়তি বন্দির চাপে রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারসহ বিভাগের আট জেলার কারাগারগুলোতে ত্রাহি অবস্থা বিরাজ করছে। রাজশাহীসহ বিভাগের কারাগারগুলিতে ধারণ ক্ষমতার চেয়ে কোথাও তিনগুণ আবার কোথাও চারগুণ বেশি বন্দি রয়েছেন।

বাড়তি বন্দির চাপে সামগ্রিক বন্দি ব্যবস্থাপনায় বেশ চাপে রয়েছেন কর্মকর্তারা। পাশাপাশি কারাভ্যন্তরে বন্দিদের সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিতে সমস্যা প্রকট হলেও ওয়ার্ডগুলোতে গাদাগাদি করে বন্দি রাখা হচ্ছে। অস্বাভাবিক চাপ বাড়ায় ওয়ার্ডের বাইরেও খোলা স্থানে বিশেষ ব্যবস্থায় রাখা হচ্ছে নতুন বন্দিদের।

সম্প্রতি কারামুক্ত বেশ কয়েকজন বন্দির সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে। ভেতরের বন্দিরাও সাক্ষাৎ করতে যাওয়া স্বজনদের এমন সব তথ্য জানিয়েছেন।

তবে রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার আব্দুল জলিল অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছেন, কারাগারে বন্দির চাপ থাকলেও ওয়ার্ডের বাইরে খোলা স্থানে বিশেষ ব্যবস্থায় বন্দি রাখার অভিযোগ সঠিক নয়। কেউ হয়তো বাইরে গিয়ে ভুল তথ্য দিয়েছেন। কারাভ্যন্তরে খোলা জায়গায় টিনের শেড বানিয়ে বন্দি রাখা কোনভাবেই সম্ভব নয়। নিরাপত্তার কারণেও এটি সম্ভব নয়।

কারা কর্মকর্তা, বন্দিদের স্বজন ও সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, সাম্প্রতিক রাজনৈতিক অস্থিরতায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ধরপাকড়ে দেশের কারাগারগুলিতে বন্দিদের চাপ বেড়েছে।

সূত্র মতে, দেশের ৬৮টি কারাগারের মধ্যে রাজশাহী বিভাগের কারাগারগুলিতে বর্তমানে ধারণ ক্ষমতার তিনগুণের বেশি বন্দি রয়েছে। এর মধ্যে প্রতিদিনই তিন শতাধিক করে নতুন বন্দি আসছে কারাগারগুলোতে। সে তুলনায় জামিনে বের হচ্ছে কম। ফলে বন্দি ব্যবস্থাপনা ও কারাভ্যন্তরে বন্দিদের সুযোগ সুবিধা নিশ্চিতেও সমস্যা হচ্ছে।

রাজশাহী কারা বিভাগের ডিআইজি প্রিজন্স দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারসহ বিভাগের আট কারাগারে বন্দি ধারণ সক্ষমতা ৪ হাজার ১৪৪ জন। এ ধারণ সক্ষমতার বিপরীতে বৃহস্পতিবার দিন পর্যন্ত বিভাগের আট কারাগারে রয়েছেন ১৪ হাজার ৪৪৩ জন বন্দি।

কারা সূত্রমতে, সাম্প্রতিক সময়ে কারাগারগুলিতে যারা নতুন বন্দি হয়ে আসছেন তাদের ৯০ ভাগই আসছেন রাজনৈতিক মামলার আসামি হয়ে। ভুক্তভোগী স্বজনদের দাবি, রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারের ওয়ার্ডগুলি এখন বন্দিতে ঠাঁসা। একজনের জায়গায় ভাগাভাগি করে থাকতে হচ্ছে তিন চার জনকে। অনেকেই রাতে পালা করে ঘুমাচ্ছেন। প্রাকৃতিত ক্রিয়া কর্ম সম্পাদনেও চরম ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে বন্দিদের।

রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগার সূত্রে জানা গেছে, রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারের বন্দি ধারণ ক্ষমতা ১ হাজার ৪৬০ জন। তবে বৃহস্পতিবার দুপুর পর্যন্ত এই কেন্দ্রীয় কারাগারে ৩ হাজার ৮৭৯ জন বন্দি ছিলেন। বর্তমানে রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে ধারণ ক্ষমতার চেয়ে প্রায় ৩ গুণ বেশি বন্দি আছেন। জানা গেছে, রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে নারী ওয়ার্ডসহ মোট ৭টি বন্দি ওয়ার্ড রয়েছে। এগুলির মধ্যে ৩ টি পুরুষ হাজতী ওয়ার্ড ও ২টি পুরুষ কয়েদি ওয়ার্ড। প্রতিটি ওয়ার্ডের বন্দি ধারণ ক্ষমতা ২৩০ জন করে। এর বিপরীতে বর্তমানে প্রতি ওয়ার্ডে বন্দি থাকছেন ৬৫০ জনের বেশি।

এ ছাড়া কারাগারে নারী বন্দিদের জন্য রয়েছে পৃথক একটি ওয়ার্ড। ৪৪ হাজতী কয়েদি নারী ওয়ার্ডের ধারণ ক্ষমতা ৪৪ জন হলে বর্তমানে আছেন ১৮৫ জন নারী বন্দি। সেই সঙ্গে রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারের চারটি ভবনে ৫৭টি সেল বা নির্জন প্রকোষ্ঠ রয়েছে। প্রতিটি সেলে ৪/ ৫ জন করে দণ্ডপ্রাপ্ত কয়েদি রয়েছেন।

এদিকে কারা অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, রাজশাহী কারা বিভাগের অধীন বগুড়া জেলা কারাগারে ৭৮৫ বন্দির ধারণ সক্ষমতার বিপরীতে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত সেখানে ২ হাজার ৪৩১ জন বন্দি আছেন। বগুড়া কারাগারেও ধারণ ক্ষমতার চারগুণ বেশি বন্দি থাকায় বন্দি ব্যবস্থাপনায় হিমশিম খাচ্ছেন কারা কর্তৃপক্ষ। বগুড়া জেলা কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার আনোয়ার হোসেন জানান, বেশি বন্দি থাকলে সকল বন্দির সুযোগ সুবিধা নিশ্চিতে কিছুটা সমস্যা হয়। তারপরও আমরা বন্দিদের সুযোগ সুবিধা ঠিকমতো দিতে পারছি। আপাতত: কোনো সমস্যা নেই।

অন্যদিকে রাজশাহী কারা বিভাগের অধীন নাটোর জেলা কারাগারে ২০০ বন্দি ধারণক্ষমতার বিপরীতে বন্দি রয়েছেন ১ হাজার ৩৮৮জন। সাম্প্রতিক সময়ে অতিরিক্ত প্রায় নতুন তিনশ বন্দি কারাগারে এসেছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। নওগাঁ জেলা কারাগারের বন্দি ধারণক্ষমতা ৫৫০জন। কিন্তু বৃহস্পতিবার পর্যন্ত নওগাঁ জেলা কারাগারে ১ হাজার ৯১২ জন বন্দি ছিলেন। জয়পুরহাট জেলা কারাগারে ১২৭জন ধারণ ক্ষমতার বিপরীতে বন্দি আছেন ৭৮৮জন। পাবনা জেলা কারাগারে ৫৭১ বন্দি ধারণক্ষমতার বিপরীতে আছেন ১ হাজার ৪৮৯ জন। সিরাজগঞ্জ জেলা কারাগারে ৬০০ ধারণক্ষমতার বিপরীতে বর্তমানে বন্দি আছেন ১ হাজার ৫১৯ জন। চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা কারাগারে ৫৮৬ বন্দি ধারণক্ষমতার হলেও বৃহস্পতিবার দুপুর পর্যন্ত বন্দি আছেন ১ হাজার ৩৭ জন।

এদিকে রাজশাহী বিভাগের আট কারাগারে বন্দির সংখ্যা বাড়ায় বন্দি ব্যবস্থাপনায় বেশ সঙ্কটে আছেন ছোট জেলা কারাগারগুলি। এসব জেলা কারাগারের কয়েকজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে বলেন, বড় কারাগারগুলিতে বন্দি বেশি হলেও তারা কাজ চালিয়ে নিতে পারেন। কিন্তু ছোট কারাগারগুলিতে বাজেট ও জনবল সঙ্কট থাকায় বন্দি ব্যবস্থাপনায় সঙ্কট প্রকট হচ্ছে। একজনের খাবার দু’জনকে ভাগাভাগি করে দিতে হচ্ছে।

রাজশাহী বিভাগের কারা উপ-মহাপরিদর্শক (ডিআইজি প্রিজন্স) কামাল হোসেন বলেন, আগে থেকেই রাজশাহীসহ বিভাগের কারাগারগুলোতে ধারণক্ষমতার তুলনায় বন্দিসংখ্যা কিছুটা বেশি আছে। সাম্প্রতি সময়ে বন্দির সংখ্যা বাড়লেও আমরা তা অস্বাভাবিক কিছু মনে করছি না। বন্দিদের সুযোগ সুবিধা আগের মতোই নিশ্চিত করা হচ্ছে।