মিয়ানমার থেকে ছোড়া মর্টার শেল এসে পড়ল বাংলাদেশে

মিয়ানমার থেকে ছোড়া মর্টার শেল এসে পড়ল বাংলাদেশে

মিয়ানমার থেকে ছোড়া তিনটি মর্টার শেল বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির তুমব্রু সীমান্তে এসে পড়েছে। এতে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন স্থানীয়রা। গতকাল বুধবার মর্টারশেলটি বাংলাদেশের ভেতরে এসে পড়ে। এতে কোনো হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি।

এ বিষয়ে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘তুমব্রু সীমান্তে কোনাপাড়া ও পশ্চিমকুল পাড়া এলাকায় মিয়ানমারের ছোঁড়া তিনটি মর্টার শেল এসে পড়েছে। আমার এলাকায় পশ্চিমকূলে বসবাসকারী নুরুল ইসলাম ও সাবেক মেম্বার গফুর চৌধুরীর বাড়ির উঠানে এসে মর্টার শেল পড়েছে। তবে কেউ হতাহতে হয়নি।’ তিনি বলেন, ‘মর্টার শেলগুলো বিজিবির কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। রাতে ব্যাপক মর্টার শেল ও গোলাগুলি হলেও গতকাল বুধবার সকাল থেকে কিছুটা কমেছে। এই সীমান্তের অধিকাংশ লোকজনের সংসার চলে চাষাবাদ করে। কিন্তু সীমান্তে গোলাগুলির ঘটনায় এসব লোকজন জীবিকা নির্বাহ করতে হিমশিম খাচ্ছেন।’

এদিকে গত মঙ্গলবার দিবাগত রাতে ও দুপুরে এবং বুধবার ভোরে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি ইউনিয়নের ঘুমধুমের তুমব্রু, কক্সবাজারের উখিয়ার পালংখালী আঞ্জুমানপাড়া, টেকনাফের হোয়াক্যং সীমান্তের ওপারে মিয়ানমার অংশে প্রচণ্ড গোলাগুলির শব্দ শুনেছেন বাসিন্দারা। এ ঘটনায় বান্দরবান জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা ও বিজিবির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন।

স্থানীয়রা জানান, দীর্ঘদিন ধরে নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তের ওপারে মিয়ানমারের অভ্যন্তরে সরকারি জান্তা বাহিনী ও বিদ্রোহীদের মধ্যে থেমে থেমে সংঘাত চলমান। এ সংঘাতে বিভিন্ন সময় নিক্ষিপ্ত গোলা তাদের সীমানা পেরিয়ে নাইক্ষ্যংছড়ির সীমান্তবর্তী লোকালয়ে এসে পড়ছে। এতে নিত্যদিনের কাজে ও শিক্ষার্থীদের স্কুলে পাঠাতেও ভয় পাচ্ছেন অভিভাবকরা।

তুমব্রু ঘোনারপাড়া এলাকার বাসিন্দা আবু সিদ্দিক বলেন, গত মঙ্গলবার মধ্যরাতে গোলাগুলি শুরু হলে ভয়ে কাঁচাঘরের বাসিন্দারা পাড়ার বা কাছাকাছি পাকা দালানে গিয়ে আশ্রয় নেন। গতকাল রাতে যখন আবারো গোলাগুলি শুরু হয় তখন অন্যের ঘরে আশ্রয় না পেয়ে সীমান্ত সড়কের ওপারে আশ্রয় নিয়েছিলাম।

এদিকে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে গতকাল বুধবার সকাল সাড়ে ১১টার দিকে সীমান্ত এলাকা পরিদর্শন করেছেন জেলা প্রশাসক শাহ্ মোজাহিদ উদ্দিন। তিনি বলেন, যেকোনো ধরনের অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে সীমান্তের এসএসসি পর স্থানান্তর করা হবে। বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম ও তুমব্রু সীমান্তে পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হলেও জনমনে এখনও আতঙ্ক কাটেনি। এক প্রশ্নের জবাবে তুমব্রু সীমান্তে মর্টারশেল উদ্ধারের বিষয়টি তিনি স্বীকার করেন। উখিয়ার পালংখালী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এম. গফুর উদ্দিন চৌধুরী বলেন, মিয়ানমারের চলমান সংঘাতে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের আশঙ্কা রয়েছে। তাছাড়া মিয়ানমারে দুপক্ষের মধ্যে যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হওয়ায় রাখাইন প্রদেশের সাধারণ জনগণ তীব্র খাদ্য সঙ্কটে বাংলাদেশে ঢুকে পড়ার পথ খুঁজছেন।

অন্যদিকে নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের অনুমান, মিয়ানমারে বিদ্রোহীদের সঙ্গে সেনাবাহিনীর সংঘাতের জেরে বাংলাদেশের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়তে পারে। রাখাইনসহ আশপাশ অঞ্চলের আরো চার লাখের বেশি রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশে প্রবেশের সুযোগ করে দিতে টেকনাফ এবং উখিয়া ক্যাম্পের রোহিঙ্গারা অপ্রীতিকর ঘটনার সৃষ্টি করতে পারে। নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা এমন সব আশঙ্কা প্রকাশ করায় ক্যাম্পগুলোতে নিরাপত্তা জোরদারের পাশাপাশি গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হয়েছে।

এদিকে মিয়ানমার অংশে অবস্থানরত স্বজনদের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন বাংলাদেশের ক্যাম্পের রোহিঙ্গারা। এ অবস্থায় অপ্রীতিকর ঘটনা সৃষ্টির চক্রান্ত রুখে দিতে ক্যাম্পে গোয়েন্দা নজরদারির পাশাপাশি নিরাপত্তা জোরদারে দেয়া হয়েছে নানা নির্দেশনা।

বেশ কিছুদিন যাবত মিয়ানমার সীমান্ত এলাকায় ভারী অস্ত্র থেকে গুলি এবং মর্টারশেলের শব্দ শোনা গেলেও গত কয়েক দিন থেকে থেমে থেম কিছু গোলাগুলির শব্দ শোনা যাচ্ছে, মাঝে মধ্যে দেখা যাচ্ছে আগুনের ধোঁয়া। এতে টেকনাফ এবং উখিয়া ক্যাম্পের রোহিঙ্গারা অপ্রীতিকর ঘটনার সৃষ্টি করতে পারে বলে মনে করছেন নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা। আর এতেই শঙ্কার সৃষ্টি হয়েছে বাংলাদেশের কক্সবাজার জেলার টেকনাফ এবং উখিয়ায় অবস্থানরত রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোর নিরাপত্তা নিয়ে। মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সংঘাত এখানে উস্কানি হিসাবে কাজ করতে পারে বলে শঙ্কা করছেন নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা।

নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর অব. এমদাদুল ইসলাম এর বরাতে জানা যায়, ‘সেখানে এক ধরনের নাশকতা হওয়ার আশঙ্কা আছে। কাজেই ক্যাম্পে নিরাপত্তা জোরদার করতে হবে।’ মিয়ানমারের রাখাইনে সংঘাতময় পরিস্থিতিতে সেখানে বসবাসকারী রোহিঙ্গারাও আতঙ্কে রয়েছেন। এতে কক্সবাজার ও টেকনাফের বিভিন্ন ক্যাম্পে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গারা রাখাইনে অবস্থানরত স্বজনের জন্য উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন। তবে নতুনভাবে যাতে একজন রোহিঙ্গাও আর এ দেশে অনুপ্রবেশ করতে না পারে, সে ব্যাপারে সতর্ক রয়েছে সীমান্তরক্ষী বাহিনী বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)।

তবে ইতিমধ্যে গত সোমবার কক্সবাজারে মাঠ পর্যায়ে দায়িত্ব পালন করা বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধিদের নিয়ে কোর কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এতে সিদ্ধান্ত হয়, মিয়ানমারের উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সীমান্তের এপারে ‘অনুকূল’ পরিবেশ থাকায় ওপাশ থেকে রোহিঙ্গারা যাতে এ দেশে ঢুকতে না পারে তা নিশ্চিত করতে হবে। প্রায় ১৪ লাখ রোহিঙ্গার বোঝা বাংলাদেশের ওপর। নতুন আর কাউকে জায়গা দেওয়া বাংলাদেশের পক্ষে কষ্টসাধ্য এই বার্তা রোহিঙ্গাদের দিতে হবে। সীমান্ত এলাকায় কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। এক বার্তায় চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি নূরে আলম মিনা বলেন, ‘থানা, সার্কেল, ফাঁড়ি, ক্যাম্প-তারাও খুব সতর্ক অবস্থায় আছে। আমরা এ মুহূর্তে এপিবিএনের সদস্যদেরও সতর্ক রেখেছি।’

বর্তমানে উখিয়ার কতুপালং হয়ে টেকনাফের উনচিপ্রাং পর্যন্ত বিস্তৃত ক্যাম্পগুলোর নিরাপত্তায় নিয়োজিত আমর্ড পুলিশের স্বতন্ত্র তিনটি ব্যাটেলিয়ন। একই সাথে একাধিক আনসার ক্যাম্প। তবে সাম্প্রতিক উত্তেজনাকর পরিস্থিতিতে আর্মড পুলিশের পক্ষ থেকে চেকপোস্ট বাড়ানো হয়েছে, পাশাপাশি ক্যাম্পের অভ্যন্তরে টহলও দিচ্ছে তারা। এপিবিএন-৮ অধিনায়ক মোহাম্মদ আমির জাফর বলেন, ‘আমাদের চেকপোস্ট যেকোনো রকম মুভমেন্ট কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করছে। তো এখন পর্যন্ত আমরা সেরকম কোনো প্রতিক্রিয়া লক্ষ করিনি।’