বেচে আছি-২

চেনা মানুষের অচেনায় যাত্রা

চেনা মানুষের অচেনায় যাত্রা

শফিক রেহমান

২০১৭-র শেষ দিকে এবং নতুন বছরের শুরুর দিকে কিছু দৈনিক পত্রিকায় বিগত বছরের সালতামামি প্রকাশিত হয়। এসব সালতামামির বিষয় হয় ভিন্ন। যেমন, এই বছর ২০১৮-তে চোখে পড়ছে ব্যাংকিং খাতে বিপর্যয়, এবং বিশেষত রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মানবেতর জীবনধারণ। এ ছাড়া অন্যান্য বছরের মতো খুন, ধর্ষণ, অপহরণ, গুম ইত্যাদি তো আছেই। আরো আছে, বিগত বছরে যারা মারা গেছেন তাদের সংক্ষিপ্ত জীবনী।

তাদের জীবনী পড়লে বুঝতে পারি যে, আমি এখনো বেচে আছি।
কিন্তু একই সাথে উপলব্ধি করি, এদের মৃত্যুর সাথে সাথে আমার জীবনের কিছু অংশ স্মৃতিতে রূপান্তরিত হয়েছে। ফলে এদের মৃত্যু আমার জীবনের একটি অংশের মৃত্যুর কারণ হয়ে গিয়েছে।
আর এভাবে আমি নিজেও এই ৮৩ বছর বয়সে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে চলার পথে ক্রমেই স্মৃতি হয়ে যাচ্ছি। কিন্তু তার পরেও সান্ত্বনা এই যে, দেশে ও বিদেশে এত বিপদ-বিপর্যয় সত্ত্বেও আমি তো এখনো বেচে আছি। নতুন সঙ্গী পাচ্ছি দেশে ও বিদেশে এবং যারা গত বছরে পরলোকে চলে গেছেন তাদের বিষয়ে লিখতে পারছি।

২০১৭-তে যেসব বিশিষ্টজনের মৃত্যু হয়েছে, তাদের মধ্যে অন্তত আটজনকে জানার অথবা তাদের কাছাকাছি যাবার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। খুবই স্বাভাবিক কারণে আমার স্মৃতিচারণে এরা চলে আসছেন।
এক. ৩ নভেম্বরে মারা যান সাবেক প্রেসিডেন্ট আবদুর রহমান বিশ্বাস (৮৯)। ১৯৫০-এর দশকে তিনি আইন পেশা শুরু করেন। ১৯৬২ ও ১৯৬৫তে পূর্ব পাকিস্তান আইন সভার সদস্য হন। ১৯৬৪তে জাতিসংঘের ২২তম অধিবেশনে যোগ দেন। ১৯৭৯তে বরিশাল থেকে তিনি এমপি নির্বাচিত হন ও প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের মন্ত্রিসভায় পাটমন্ত্রী হন। এরপরে বিচারপতি আবদুস সাত্তারের মন্ত্রিসভায় স্বাস্থ্যমন্ত্রী হন। পঞ্চম জাতীয় সংসদে প্রথমে জাতীয় সংসদের স্পিকার ও পরে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। প্রেসিডেন্ট থাকার সময়ে মে ১৯৯৬তে তিনি দেশের একটি সামরিক ক্যুর চেষ্টা ব্যর্থ করে দেন। প্রেসিডেন্ট আবদুর রহমান বিশ্বাস দৈহিক গড়নে ছিলেন ছোটখাটো। কিন্তু এই সময়ে তার সাহস ছিল বিশাল ও দুর্দমনীয়। এর প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী। তার সেই সাহসের কারণে পরবর্তী ১১ বছরে বাংলাদেশে কোনো সামরিক ক্যু হয়নি।

প্রেসিডেন্ট বিশ্বাসের সঙ্গে রাষ্ট্রপতি ভবনের কয়েকটি অনুষ্ঠানে কয়েকবার কথা হয়েছিল। মে ১৯৯৬-এ ক্যুর সময়ে সামরিক কর্মকর্তাদের চাপ নাকচ করে দিয়ে তিনি বলেছিলেন, ডেথ বিফোর ডিজঅনার (Death before dishonour) অর্থাৎ অসম্মানের আগে মৃত্যুই শ্রেয়। কোনো উচু পদে বাংলাদেশে এমন সাহসী মানুষ দুর্লভ।

দুই. ৬ জুনে প্রধান বিচারপতি ও ২০০১-এ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা লতিফুর রহমান (৮১) মারা যান। তার চাকরিজীবন শুরু হয় শিক্ষকতা দিয়ে। এরপর ১৯৬০-এ তিনি আইন পেশায় যান। ১৯৭৯তে তিনি হাই কোর্টের বিচারক নিযুক্ত হন। ২০০১ প্রধান বিচারপতি পদে দায়িত্ব পালন শেষে তিনি অবসর নেন। ১৯৯৬-২০০১-এর আওয়ামী লীগ সরকারের মেয়াদ শেষে, তখনকার নিয়ম অনুযায়ী সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি হিসেবে ১০ জুলাই ২০০১-এ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হন লতিফুর রহমান। ২০০১-এ নির্বাচনের পর ১০ অক্টোবরে তিনি আবার অবসরে গেলেও ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দিনগুলি ও আমার কথা’ (পরিবেশক : মল্লিক ব্রাদার্স, ৪২ বাংলাবাজার, ঢাকা) নামে একটি বইয়ে লতিফুর রহমান তার ৮৭ দিন সরকার পরিচালনার অভিজ্ঞতার কথা লিখে গেছেন। ২০০১-এর আগের দু’টি তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান সম্পর্কে কোনো বিতর্ক, সমালোচনা ও কটূক্তি তখনকার পত্রপত্রিকায় দেখা যায়নি। কিন্তু অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান সম্পর্কে কিছু রাজনৈতিক দল থেকে প্রচুর সমালোচনা করা হয়- এমনকি তাকে ‘মোনাফেক’ টাইটেলও দেয়া হয়। লতিফুর রহমান এমন সমালোচনার উত্তর দিয়েছেন তার এই বইয়ে এবং এটি ভবিষ্যতের যেকোনো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের জন্য অবশ্যপাঠ্য। লতিফুর রহমান এই বইয়ের ছোট মুখবন্ধে লিখে গেছেন : ‘‘গণতান্ত্রিকভাবে সরকার পরিবর্তনের একমাত্র পথ হচ্ছে সুষ্ঠু নির্বাচন। আমাদের দেশে নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে ও সঠিক সময়ে যদি নির্বাচন হতো, তাহলে এত দিনে গণতন্ত্র সুশ্রী অবয়ব পেত বলে আমার বিশ্বাস... এই বই লেখার সময়ে ইংরেজ লেখক স্যার ওয়াল্টার স্কটের দু’টি লাইন আমার বিশেষভাবে মনে হচ্ছিল। তা পাঠকদের জন্য তুলে ধরার লোভ সংবরণ করতে পারছি না। লাইন দু’টি এরূপ- 'Without courage there cannot be truth and without truth there can be no other virtue' (সাহস ছাড়া সত্য প্রতিষ্ঠিত হয় না এবং সত্য না থাকলে অন্য কোনো গুণই থাকে না)। জীবনে সৎসাহসের অভাব আমার কোনো ক্ষেত্রেই ছিল না। সাহসিকতা ও সততার সাথেই সব কাজ করেছি।’’

ইংরেজি ভাষার ছাত্র লতিফুর রহমানের সাথে আমার প্রথম পরিচয় হয় ঢাকা কলেজে ১৯৫০-এ। তাকে আমরা তার ডাক নাম ‘শান্তি’ ও আমাদের দেয়া নাম ‘ব্রাদার’ বলে ডাকতাম। তার সঙ্গে শেষ দেখা হয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারে প্রধান উপদেষ্টা পদ ছেড়ে দেয়ার সময়ে। তিনি শুধু যে সৎ ও সাহসী ছিলেন তা নয়। তিনি খুবই বিনয়ী, অমায়িক, মার্জিত ও শালীন ব্যক্তি ছিলেন। নিরহঙ্কারী লতিফুর রহমান যখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ছিলেন, তখন একদিন হাসতে হাসতে আমাকে বলেছিলেন, ‘ভাগ্যিস এমএতে থার্ড ক্লাস পেয়েছিলাম। সেকেণ্ড ক্লাস পেলে নিশ্চয়ই সিএসএস পরীক্ষা (বর্তমানে বিসিএস) দিয়ে পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসে যোগ দিতাম। হয়তো সিএসপি হতাম, কিন্তু সেটা না হয়ে আজকে সবচেয়ে উচু পদেই আমি এসেছি।’

তার এমএ পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট না হওয়ার বিষয়টি বইয়ের ২৩ পৃষ্ঠায় লেখা আছে।
তিন. সাবেক মন্ত্রী সুরঞ্জিৎ সেনগুপ্ত (৭২) মারা যান ৫ ফেব্রুয়ারিতে। রাজনীতিতে তার স্থিরতা ছিল না। বামপন্থীরূপে ন্যাপ, একতা পার্টি, গণতন্ত্রী দলে সংশ্লিষ্টতার পর পরিচিত এই নেতা নব্বইয়ের দশকে আওয়ামী লীগে যোগ দেন। সত্তরের নির্বাচনে তদানীন্তন প্রাদেশিক পরিষদের এই সদস্য স্বাধীনতার পর বৃহত্তর সিলেটের সুনামগঞ্জ-২ আসন থেকে সাতবার এমপি নির্বাচিত হন। নবম সংসদে আওয়ামী লীগ সরকারে তিনি রেলমন্ত্রী হন। সরকারি টাকা কেলেঙ্কারির একটি ঘটনা ফাস হয়ে যাবার পর তিনি পদত্যাগ করলেও প্রধানমন্ত্রী সেই পদত্যাগপত্র গ্রহণ না করে তাকে দফতরবিহীন মন্ত্রী করেন। বাকপটু এই পলিটিশিয়ান একবার বিরোধীদের বিষয়ে বলেছিলেন, ‘বাঘে ধরলে বাঘে ছাড়ে- কিন্তু হাসিনা ধরলে কাউকে ছাড়ে না।’ তার উক্তি ভালো অর্থেও প্রমাণিত হয়- হাসিনা তাকেও ছাড়েননি। এরশাদ আমলে তিনি তার হার্টে বাইপাস সার্জারির জন্য লন্ডনে এসেছিলেন। তখন আমি নির্বাসিত ছিলাম এবং তার সঙ্গে দীর্ঘ আলাপচারিতা হয়েছিল।

চার. চট্টগ্রামের সাবেক মেয়র এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী (৭৪) মারা যান ১৪ ডিসেম্বরে। মহিউদ্দিন চৌধুরী চট্টগ্রামে ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও শ্রমিক লীগের শীর্ষ পদে ছিলেন। ১৯৯৪ থেকে ২০০৫ পর্যন্ত চট্টগ্রাম সিটি কর্পরেশনের মেয়র পদে ছিলেন। এই সময়ে তিনি চট্টগ্রাম শহরে সৌন্দর্য, পরিচ্ছন্নতা, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সেবায় নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। তার অন্যতম ছিল দেশের প্রথম এয়ার কনডিশন্ড পাবলিক টয়লেট প্রতিষ্ঠা। তার বাসভবন চশমা হিলে তাকে ইন্টারভিউ করার সুযোগ আমার হয়েছিল। হয়তো এক পর্যায়ে চট্টগ্রামে তার জনপ্রিয়তা ও প্রভাবের বিষয়ে তিনি মাত্রাতিরিক্ত ধারণা পোষণ করেন। ফলে জীবনের শেষ দিকে তিনি ক্ষমতার বৃত্ত থেকে দূরে সরে যেতে বাধ্য হন।

পাচ. বিএনপি সরকারের সাবেক মন্ত্রী এম কে আনোয়ার (৮৫) মারা যান ২৪ অক্টোবরে। কৃতী ছাত্র এম কে আনোয়ার ১৯৫৬তে সিএসপি হন। তার ৩৪ বছরের পেশাগত জীবনে, ফরিদপুর ও ঢাকার ডিসি, জুট মিলস কর্পরেশন, টেক্সটাইল মিলস কর্পরেশন ও বাংলাদেশ বিমানের চেয়ারম্যান, অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ, অর্থ, স্বরাষ্ট্র ও মন্ত্রিপরিষদ সচিবরূপে দায়িত্ব পালন শেষে ১৯৯০-এ অবসর নেন তিনি। ১৯৯১-এর পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে বিএনপিতে যোগ দেয়ার পর কুমিল্লা-১ আসন থেকে টানা পাচবার এমপি নির্বাচিত হন এবং দুইবার পূর্ণ মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। তিনি বিএনপির স্ট্যান্ডিং কমিটির সদস্য ছিলেন।

সিএসপি হবার সময়েই তার রাজনৈতিক অভিলাষ ছিল। তাই তিনি বিশেষত তার নির্বাচনী এলাকায় প্রভূত উন্নয়নমূলক কাজ করতেন। প্রজ্ঞাবান, স্বল্পভাষী ও বিনয়ী এম কে আনোয়ার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যখন ছিলেন তখন হয়তো তিনি ভাবেননি যে, রাজনৈতিক কারণে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে তাকেই জেলে থাকতে হবে। কাশিমপুর-২ এ তিনি যে জেল রুমে থাকতেন সেই রুমে পরবর্তী সময়ে আমিও থেকেছি। শাদাসিধা জীবনে অভ্যস্ত ভদ্রলোক, এম কে আনোয়ার থাকতেন এলিফ্যান্ট রোডে নিজের বাড়িতে এবং মাঝেমধ্যে দেখা হয়ে যেত এলিফ্যান্ট রোডের কোনো দোকানে। কথা হতো। তার মুখে মৃদু হাসি লেগেই থাকত।
ছয়. সিরামিক শিল্পের পথিকৃৎ এবং বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা হারুনার রশিদ খান মুন্নু (৮৫) মারা যান ১ আগস্টে। বাংলাদেশকে বহির্বিশ্বে সিরামিক শিল্পের ভালো প্রস্তুতকারক হিসেবে তিনিই পরিচিত করেন। এখন বাংলাদেশে মুন্নু ও সিরামিক জিনিসপত্র প্রায় সমার্থক। তারপরে এসেছে সালমান রহমানের শাইনপুকুর এবং মাহমুদুর রহমানের আর্টিজান (যেটার মালিক তিনি আর এখন নন) সিরামিকস। মুন্নুর অনুকরণে ইনডিয়াতে বিহারে সিরামিক শিল্প ব্যর্থ হয়েছে। হারুনার রশিদ খান (এইচ আর খান নামেও পরিচিত) মুন্নুর সফল হবার কারণ, তিনি ষাটের দশকের শেষে যখন ঢাকার ওয়ারিতে অবস্থিত মুন্নু ফাইন আর্ট প্রেসের ব্যবসার পাশাপাশি সিরামিকে চলে যান, তখন থেকে তিনি এই শিল্পে একাগ্রভাবে কাজ করেন এবং একে রফতানিমুখী করেন। উত্তর লন্ডনে ওয়েমবলিতে শো-রুম স্থাপন এবং অভিজাত ডিপার্টমেন্ট স্টোর হ্যারডস ও সেলফৃজেস-এ মুন্নু প্রডাক্টস বাজারজাত করেন। একজন উদারপন্থী চাকরিদাতা ও সমাজসেবকরূপেও তিনি পরিচিত হন। পরে তিনি বিএনপিতে যোগ দিয়ে মানিকগঞ্জ-২ আসন থেকে তিনবার এমপি নির্বাচিত হন ও বিএনপি সরকারের আমলে দফতরবিহীন মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন।

আমি যখন ষাটের দশকের শেষাংশে ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে চিফ একাউন্টেন্ট পদে কাজ করছিলাম তখন তার সাথে প্রথম পরিচয় হয়েছিল। তখন তিনি শুধু প্রেসের ব্যবসা করছিলেন। লক্ষ করেছিলাম হোটেলের ছাপার কোনো কাজে সামান্যতম ত্রুটির অভিযোগ করলে তিনি নিজেই সংশোধনী বুঝে নিতে হোটেলে চলে আসতেন। ‘অলওয়েজ কাস্টমার ইজ ফার্স্ট, অলওয়েজ কাস্টমার ইজ রাইট’ এই বিশ্বাস তিনি করতেন। তার অবিচল নিষ্ঠা তাকে দেশের শিল্প উন্নয়নে অগ্রণী ভূমিকা পালনে সহায়ক হয়েছিল।

সাত. লেখক ও সাবেক পররাষ্ট্র সচিব ও রাষ্ট্রদূত ফারুক আহমেদ চৌধুরী (৮৩), (ফারুক চৌধুরী নামে সমধিক পরিচিত) মারা যান ১৭ মে। তার কূটনৈতিক জীবন ছিল পঞ্চাশ বছরেরও বেশি ও বহু অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ। কিন্তু বাংলাদেশে তিনি জনপরিচিত হন কূটনৈতিক জীবন থেকে অবসর নেয়ার পরে। সাপ্তাহিক যায়যায়দিন-এ তার ধারাবাহিক আত্মজীবনীমূলক লেখা ‘দেশ দেশান্তর বিপুল পাঠকপ্রিয়তা পায়। কূটনীতিক ফারুক আহমেদ দেশান্তর চৌধুরীর নতুন জন্ম হয়- লেখক ফারুক চৌধুরী রূপে। দেশ দেশান্তরের পর যায়যায়দিনে তার আরেকটি ধারাবাহিক লেখা ‘প্রিয় ফারজানা’ (তার মেয়ের নাম ফারজানা) আবারও জনসমাদৃত হয়। এরপর অন্যান্য পত্রিকায় তিনি লেখালেখি করেন। দৈনিক প্রথম আলোতে তার বিশ্লেষণধর্মী পররাষ্ট্রনীতিবিষয়ক কলামগুলো এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য।

ফারুক চৌধুরীর সঙ্গে আমার পরিচয় ও বন্ধুত্ব হয় ঢাকা কলেজে ইন্টারমিডিয়েট জীবন থেকে। তারপর বিদেশে বহুবার দেখা হয়েছে এবং একই শহর লন্ডনে একই পাড়ায় থেকে ভিন্ন পেশায় আমরা কাজ করেছি। জুন ১৯৭১-এ মুক্তি আন্দোলনে চলে যাবার সময়ে আমি তাকে একটি মোটা ডায়রি দিয়ে যাই ধানমন্ডির পাচ নাম্বার রোডে সুরমা বাড়িতে। বলেছিলাম আমাদের মুক্তি সংগ্রামের বড় ঘটনাগুলোর দিনপঞ্জী লিখে রাখতে। তিনি সেটা করেছিলেন, যার ফলে তিনি সঠিক তথ্যপূর্ণভাবে পরবর্তীকালে পাঠকদের অনেক কিছু জানাতে পেরেছিলেন। তবে আমি মনে করি, তিনি আরো অনেক কিছু জানতেন যেসব প্রকাশ করেননি। এর অন্যতম কারণ বোধহয়, যদিও তিনি শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিবেশী ছিলেন বত্রিশ নাম্বার রোডে এবং তার আস্থাভাজনও ছিলেন (ফারুক চৌধুরীর প্রথম বোন নাসিমের স্বামী কর্নেল হাই মুক্তিযুদ্ধের সূচনাতে যশোর ক্যান্টনমেন্টে নিহত হয়েছিলেন), তবুও ওয়ান-ইলেভেনের পর, যখন ফখরুদ্দীন আহমেদ (ফারুক চৌধুরীর দ্বিতীয় বোন নীনার স্বামী) জেনারেল মইনের সেনা সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হন এবং ফারুক চৌধুরীর সর্বকনিষ্ঠ ভাই ইফতেখার আহমেদ চৌধুরী ওই সেনা সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী -হন- তার আওয়ামী লীগের সাথে ফারুক চৌধুরীর সঙ্গে আওয়ামীলীগ সরকারের দূরত্ব সৃষ্টি হয়।

তবে ফারুক চৌধুরী সবকিছুই হিউমারাসভাবে নিতেন। ক্যান্সার রোগাক্রান্ত হবার পর জানুয়ারি ২০১৭-তে আমার স্ত্রী তালেয়া লন্ডনে চলে যান। সেও ছিল ফারুক চৌধুরীর সমপাঠী ও বন্ধু। বন্ধু হবার একটা বড় কারণ ছিল, ফারুক চৌধুরী ছিলেন ভোজে আগ্রহী এবং তালেয়া রান্নায় আগ্রহী। তালেয়ার পাশে থাকার জন্য সুপৃম কোর্টের অনুমতি নিয়ে লন্ডনে যাবার আগে আমি ফারুক চৌধুরীকে দেখতে ধানমন্ডি/মিরপুর রোডে একটি হসপিটালের ক্যাবিনে যাই। গভীর অসুস্থতা ও শ্বাসপ্রশ্বাসে কষ্ট হওয়া সত্ত্বেও তিনি লন্ডনে তালেয়ার সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথা বলেন। তারপর নার্সকে ইশারায় একটি কাগজ ও বলপয়েন্ট দিতে বলেন। ফারুক চৌধুরী ছোট চিঠি লিখেছিলেন, ‘বেচে থাকার জন্য আমরা দুজনাই লড়াই করছি। আমরা দুজনাই জয়ী হবো। আমাদের দেখা হবে পরপারে নয়- এই ভুবনেই।’

দুঃখের বিষয় এই ভুবনে তাদের পুনর্বার দেখা সম্ভব হয়নি।
আট. গার্মেন্টস শিল্পপতি ও উত্তর ঢাকার উদ্যমী মেয়র আনিসুল হক (৬৭) মারা যান লন্ডনে ওয়েলিংটন হসপিটালে ৩০ নভেম্বরে। তবে তার মৃত্যুর বেশ কয়েক সপ্তাহ আগে থেকেই লন্ডনে আমার কাছে ফোন আসছিল যে, তিনি একটি দলীয় চক্রান্তের শিকার হয়ে মারা গিয়েছেন। আমি এ কথা সত্য নয় বলা সত্ত্বেও ঢাকার অনেকেই সেটা মেনে নিতে পারছিল না। আনিসুল হক সেপ্টেম্বরে ছিলেন উত্তর লন্ডনে (আমার বাড়ির কাছেই) রয়াল ফৃ হসপিটালে।সেখান থেকে তাকে ট্রান্সফার করা হয় সেন্ট্রাল লন্ডনে কুইন্স স্কোয়ারে ন্যাশনাল নিওরোলজিকাল ইন্সটিটিউটের বিশেষ হসপিটালে। এই নিওরোলজিকাল হসপিটালে আমি আর তালেয়া এক শনিবার বিকেলে আনিসুল হককে দেখতে গিয়েছিলাম। সেই সময়ে উপস্থিত ছিলেন তার স্ত্রী রুবানা ও তার টেলিভিশন প্রজেক্টের কর্মকর্তা আবদুন নূর তুষার। এ ছাড়া উপস্থিত ছিলেন আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ব্যারিস্টার ভিখারুল ইসলাম চৌধুরীর ছেলে শামুন চৌধুরী, যাকে লন্ডনে জন্ম হওয়া অবধি আমি দেখে এসেছি। তিনি ওই ন্যাশনাল নিওরোলজিকাল হসপিটাল থেকেই কোয়ালিফাই করেন এবং এখন পঞ্চাশোত্তীর্ণ ড. শামুন চৌধুরী বৃটেনের একজন নেতৃস্থানীয় নিওরোলজিস্ট। তিনি আমাকে সেদিন প্রাইভেটলি বলেছিলেন, খুবই দুরারোগ্য রোগে পড়েছেন আনিসুল এবং ডাক্তাররা তাকে ইনডিউসড কোমা, অর্থাৎ ঘুম পাড়িয়ে রেখেছেন সেপ্টেম্বর থেকে। শেষ পর্যন্ত তাকে ট্রান্সফার করা হয় সেন্ট্রাল লন্ডনে লর্ডস কৃকেট ময়দানের পাশে ওয়েলিংটন হসপিটালে। আমি সেখানেও গিয়েছিলাম। সেখান থেকে তিনি চিরবিদায় নেন। পরে জেনেছি তিনি এক ধরনের ভার্টিগোতে ভুগছিলেন এবং লন্ডনেই (যেখানে তার মেয়ে থাকে) চিকিৎসা নিতে চেয়েছিলেন।

টিভি উপস্থাপক হিসেবে তাকে আমি প্রথম চিনি। তারপর জানি একটি মালটিন্যাশনাল ও একটি ন্যাশনাল কম্পানির সাধারণ স্টাফরূপে। কিন্তু উচ্চাভিলাষ, পরিশ্রম ও নিষ্ঠার ফলে তিনি শেষ অবধি গার্মেন্টস ইন্ডাস্টৃ (মোহাম্মদী গ্রুপ) প্রতিষ্ঠা করেন। তবে তিনি নিজেকে ব্যাপকতর পরিধিতে নিয়ে যান। যেমন : কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ, টেলিভিশন চ্যানেল (নাগরিক) স্থাপন ও উত্তর ঢাকার মেয়রশিপে। সেখানে তাকে বহু প্রতিকূলতার মুখোমুখি হতে হয়। হয়তো এই ব্যাপক বিস্তৃতি তার অকাল রোগের একটি কারণ ছিল। তার যে রাজনৈতিক উচ্চাকাক্সক্ষাখা ছিল সেটি ক্রমেই জানা যাচ্ছিল। বন্ধুবৎসল ও গুণী মানুষের প্রতি শ্রদ্ধাশীল আনিসুল হকের সঙ্গে মাঝেমধ্যে রাজনীতি থেকে শুরু করে মুভি ও গান বিষয়ে আলাপ হতো। তিনি নিজের খরচে অভিনেতা দিলীপ কুমারকে বাংলাদেশে এনেছিলেন। তার বাড়িতে দিলীপ কুমারের সঙ্গে আমার দীর্ঘক্ষণ আলাপ হয়েছিল। আনিসুল হক আমার অনুরোধে বাংলাদেশে লতা মংগেশকরকেও আনার চেষ্টা করেছিলেন। আনিসুল হকের মতো উদার কিন্তু দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ও বহুমাত্রিক সংস্কৃতিসেবী ঢাকার মেয়রের অকাল বিদায় একটা বড় শূন্যস্থান সৃষ্টি করেছে।

ওপরের এই আটজনের কমবেশি সান্নিধ্যে যাবার সুযোগ আমার হয়েছিল। এরা ভালোমন্দ এবং সাফল্য-ব্যর্থতায় মেশানো মানুষ ছিলেন। এরা বাদেও ২০১৭-তে বেশ কয়েকজন গুণী ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। যেমন, অভিনেতা রাজ্জাক, কণ্ঠশিল্পী আবদুল জব্বার, মুক্তিযোদ্ধা অবসরপ্রাপ্ত মেজর জিয়াউদ্দিন আহমেদ, হরি ধানের উদ্ভাবক কৃষক হরিপদ কাপালী, সংস্কৃতিসেবী লাকী আখন্দ প্রমুখ, যাদের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত পরিচয় ছিল না।

আরো একজনের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত পরিচয় ছিল না এবং তিনি ছিলেন বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের ছোট ভাই আহমেদ কামাল। আশ্চর্য! পারিবারিক বন্দনার যুগেও তিনি ছিলেন এত অপরিচিত!
সে যাই হোক। এই চেনা মানুষরা চলে গেছেন অচেনা আরেক স্থানে। আমি বেচে আছি। লিখতে পারছি। এটাই আমার জন্য সবচেয়ে বড় বিস্ময়। মনে পড়ছে, আমেরিকান মুভি ডিরেক্টর- অ্যাক্টর উডি এলেনের কথা,-আমি মৃত্যু ভয়ে ভীত নই, তবে সেটা যখন হবে তখন আমি সেখানে থাকতে চাই না- It's not that I'm afraid to die, I just don't want to be there when it happens.
৮ জানুয়ারি ২০১৮

[শফিক রেহমানের ধারাবাহিক রচনা ‘বেচে আছি’ এখন প্রকাশিত হচ্ছে। এ ছাড়া ইংরেজি মাস্টারপিস গল্পের ভাষান্তর তিনি করছেন। সেসব প্রকাশিত হচ্ছে নয়া দিগন্তের মাসিক
প্রকাশনা ‘অন্য দিগন্ত’-এ]