কাবিনবিহীন হাতে মহাকাল ছুঁলেন কবি

কাবিনবিহীন হাতে মহাকাল ছুঁলেন কবি

ফারুক ওয়াসিফ

আজ আকাশ মেঘলা আর আল মাহমুদ নেই। কাবিনবিহীন হাতে মহাকাল স্পর্শ করতে চলেছেন এখন তিনি।

রাত্রিশেষে কোনো শুভ শুক্রবারে তিনি বিদায় নিতে চেয়েছিলেন। প্রকৃতি তাঁর ডাক শুনেছে। শুক্রবার দিনশেষেই তিনি বিদায় নিলেন। আজ শনিবার ভোরে আকাশ মেঘলা। কবি তাঁর শেষ কল্পনা মাখিয়ে দিলেন আকাশে, চরাচরে, বাংলা ভাষাভাষীদের মনে। আজ নিখিল বাংলা শোক করুক। ভাষার প্রিয়তম সন্তানের জন্য, কবিতার সন্তপুরুষের জন্য শোক করুক। তাঁর শেষ ইচ্ছা পূর্ণ হয়েছে। মৃত্যুর লোবানমাখা সেই কবিতায় তিনি মৃত্যু পেরিয়ে দেখতে পান,

কোনো এক ভোরবেলা, রাত্রিশেষে শুভ শুক্রবারে
মৃত্যুর ফেরেস্তা এসে যদি দেয় যাওয়ার তাকিদ;
অপ্রস্তুত এলোমেলো এ গৃহের আলো অন্ধকারে
ভালোমন্দ যা ঘটুক মেনে নেবো এ আমার ঈদ।
ফেলে যাচ্ছি খড়কুটো, পরিধেয়, আহার, মৈথুন—
নিরুপায় কিছু নাম, কিছু স্মৃতি কিংবা কিছু নয়;
অশ্রুভারাক্রান্ত চোখে জমে আছে শোকের লেগুন

কার হাত ভাঙে চুড়ি? কে ফোঁপায়? পৃথিবী নিশ্চয়।
স্মৃতির মেঘলাভোরে শেষ ডাক ডাকছে ডাহুক
অদৃশ্য আত্মার তরী কোন ঘাটে ভিড়ল কোথায়?
কেন দোলে হৃদপিণ্ড, আমার কি ভয়ের অসুখ?
নাকি সেই শিহরণ পুলকিত মাস্তুল দোলায়!
আমার যাওয়ার কালে খোলা থাক জানালা দুয়ার
যদি হয় ভোরবেলা স্বপ্নাচ্ছন্ন শুভ শুক্রবার

(স্মৃতির মেঘলা ভোর, আল মাহমুদ)

বিদায় নিলেন বসন্তে, ভাষার মাসে। এও যেন এক প্রাকৃতিক সংকেত।

আজ আমাদের ছোট্ট পৃথিবীটা ফোঁপাচ্ছে। আজ বাংলা কবিতার চুলখোলা আয়েশা আক্তারেরা, আপনার কন্যারা চুড়ি ভেঙে ফেলছে শোকে।

আল মাহমুদ তিতাসপারের কবি, মেঘনার কিশোর। তাঁর বিখ্যাত একটি গল্পের নাম ‘পানকৌড়ির রক্ত’। সেই থেকে মেঘনার পানকৌড়ি দেখলে আপনার কথা মনে পড়ে কবি। গত কালবৈশাখীতে মেঘনায় ছিলাম। ছিলাম নৌকায়। শিলাবৃষ্টি। রাশি রাশি বরফখণ্ড নদীজুড়ে খই ফোটাচ্ছে। ভাতের বলকের মতো ফুটছিল নদী। আকাশে গুড়গুড় বাজ ও ঐশী আলোর চমকানি। ওই সর্বনাশী সুন্দরের মধ্যে একটা কালো পানকৌড়ি পানি ছুঁয়ে সমানে ডানা ঝাপটাচ্ছিল। নীড়ে ফিরতে না পারা পাখিটা! পাগলিনী বাতাস, বড় বড় বাতাসার মতো শিলাপাত। সেগুলোর একটা ঠিকমতো লাগলেই যথেষ্ট। যেদিকেই যাক, কমপক্ষে এক মাইল আকাশ উড়তে হবে পাখিটাকে। সহজাত প্রবৃত্তি তাকে শিখিয়েছে, এমন বিপদে স্থির থাকতে হবে। আমার তখন আল মাহমুদের কথা মনে পড়েছিল।

সাক্ষাৎকারে আপনি বলেছিলেন, ‘বন্ধুদের, কবিদের দেওয়া মানসিক চাপ উপেক্ষা করে সমাজে জায়গা করে নিতে হয়েছে আমাকে। কেউ কোনো স্পেস আমাকে দিতে চায়নি। অনেক ধাক্কা খেয়েছি, মুক্তিযুদ্ধ করেছি, জেলও খেটেছি। আমাকে বলো, একজন কবি আর কী কী করতে পারে?’ (নাসির আলী মামুনকে দেওয়া সাক্ষাৎকার, প্রথম আলো, ২২ জুলাই ২০১৬)

আরেক জায়গায় বলেছেন, ‘অনেক কষ্ট, অনেক দারিদ্র্য, অনেক দুঃখ পেয়েছি, আবার সুখও। জেল-জুলুম। কিছু লোক আছে, যে কবিদের প্রতারণা করে সুখ পায়। এসব প্রতারণার শিকার হয়েছি।’ (সাক্ষাৎকার, মাহবুব মোর্শেদ, দেশ রূপান্তর)

বাংলা কবিতার আহত পানকৌড়ি আল মাহমুদ। তবু কত অকপট,

আত্মবিক্রয়ের স্বর্ণ কোনোকালে সঞ্চয় করিনি
আহত বিক্ষত করে চারদিকে চতুর ভ্রুকুটি;
ভালবাসা দাও যদি আমি দেব আমার চুম্বন,
ছলনা জানিনা বলে আর কোনো ব্যবসা শিখিনি। (সোনালি কাবিন)

কবির পরকাল হলো ভাষা। তাঁর দৈহিক জীবন সমাপ্ত হলো। ভুল-সঠিকে ভরা জীবনের দেখার ইতি ঘটল। কিন্তু ভাষা তাঁকে ঠিক মনে রাখবে। সেই ভাষিক পরকালে মাত্র জেগে উঠলেন কবি। বাংলা ভাষা আপনাকে সব দায় থেকে মুক্ত করবে, কারণ আপনি এই ভাষার কবিতাকে স্ব-ভাবে ফিরিয়েছেন। আপনি বাংলার মাটির সৌরভ, নদীর কান্না, জাতির আত্মার বেদনা প্রকাশ করে গেছেন। জীবনানন্দ দাশের পর আর কেউ এতটা মায়া দিয়ে সৌন্দর্য দিয়ে দুঃখিনী বাংলার কথা বলেনি।

আল মাহমুদের অন্তিম অসুস্থতার খবরে একটা ছায়া ঘনিয়ে আসছিল মধ্যদিনে। প্রথমে কবি ও কবিতার ভক্তদের মধ্যে, তারপর এখন হঠাৎ সূর্যগ্রহণ। দুই বাংলার ভাবাকাশে আজ বড় বেদনা। আপনার প্রতিষ্ঠা ছিল না কিন্তু ভালোবাসায় সিক্ত ছিলেন আপনি। জীবন দুঃখ-দারিদ্র্যে গেছে, মসনদ আপনাকে কটাক্ষ করেছে, পরিত্যক্ত করে রেখেছে। দুঃখ-যন্ত্রণায় আপনি যাদের কাছে গেলেন, তারাও আপনাকে ব্যবহার করেছে। সেটা আপনার ভুল হতে পারে, কিন্তু একই সঙ্গে তা আমাদের সমাজ-রাষ্ট্র আর সংস্কৃতির সওদাগরদেরও দায়। মৃত্যুতে আপনার নশ্বর দেহ আর আর মানবিক ভুলগুলো মুছে যাবে, জেগে উঠবে বাংলা কবিতার মাহমুদীয় চরাচর। এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।

মহৎ কবিরা মায়াবী এক উপায়ে হিংসার বিরুদ্ধে জিতে যান। ভাষার পরকালে সে কবির জেগে ওঠা ইলিয়াসের ‘খোয়াবনামা’র সেই পাকুড়গাছের মুনশির মতো, আরশের একটু নিচ থেকে তিনি দেখে রাখেন তাঁর মায়াশাসিত পৃথিবীটাকে। জীবনের কালিমা মুছে তিনি শুদ্ধ হাঁসের মতো ক্লেদহীন থেকে যাবেন। পাঠক হিসেবে আমরাও দুধসাগর থেকে বিষ ফেলে শুধু অমিয়টাই পান করতে আসব তাঁর কাছে। আপনি লিখেছেন, ইগল থাকবে না, ইতিহাস থাকবে।

কৌম মানবের অন্তরাত্মা মায়া নামের মায়াবী শক্তির বশ। সেই আত্মা ভাষার মধ্য দিয়ে অলৌকিক অনুভূতির স্বাদ পায়। বাংলার কৃষকগীত, পুঁথি-পাঁচালি, জীবনানন্দ দাশ হয়ে আল মাহমুদ অবধি সেই মায়ার সংসার। তিনি বাংলাদেশি গ্রাম-মফস্বলি জগতের মায়াকে ভাষার কালহরা আরকে অক্ষয় করেছেন। সোনার নোলক হারিয়ে যারা মুক্তি পেয়েছে বলে ভেবেছে, সেই স্মৃতিহীন আধুনিকতার বিভ্রাট আল মাহমুদ আলগোছে এড়িয়ে গেছেন।

তিনি বাংলাদেশি রকমের আধুনিক—যেখানে বোদলেয়রীয় ক্লেদজ কুসুমের তৃষ্ণা নেই, পাপের গরিমা গাওয়া নেই। ‘আমার মায়ের সোনার নোলক হারিয়ে গেছে ভাই’ লিখে আপনি আমাদের জাতীয় শোককে জাগিয়ে রেখেছেন। আপনি যখন লিখলেন,
‘সোনার দিনার নেই, দেনমোহর চেয়োনা হরিণী

যদি নাও দিতে পারি কাবিনবিহীন হাত দুটি,’ (সোনালি কাবিন) তখন ভূমিপুত্র হিসেবে বৃক্ষের মতো সাবলীল ভঙ্গিতে আমরা মাথা তুলতে পারি। যেন দুঃখী কবির রাজকীয় অভিষেক ঘটল। জানলাম হৃদয়ের কাছে কতটা সৎ হতে হয়, কতটা শুদ্ধ হাতে তুলে নিতে হয় কলম। কেননা,

পরাজিত নই নারী, পরাজিত হয় না কবিরা;
দারুণ আহত বটে আর্ত আজ শিরা-উপশিরা। (সোনালি কাবিন)

আল মাহমুদের মধ্যে ডান-বাম, এপার-ওপার সব বাংলা একাকার। এটা কবির অর্জন কিন্তু বাংলা ভাষার জন্য এ এক বড় সম্পদ। ঔপনিবেশিকতার পরবাসী মন আর আধুনিকতার ঝুলন্ত মানিপ্ল্যান্ট কিংবা অহংবাদী মাকড়সার জালে বসা কবিতার কূলে আপনি ভেড়েননি। দুঃখী লোকের চরে ভিড়িয়েছেন আপনার নৌকা। আধুনিকতাকে পিছু ধাওয়া করতে করতে কিছুটা সে পথে গিয়েও ফিরে এসেছেন। কবিতার দেশে ফেরার খাতার খোঁজে, জগৎ-প্রকৃতি-মানুষের মায়ার আবেশ পেতে আপনাকে আমাদের লাগবেই। আপনার মধ্যেই খুঁজতে হয় জীবনানন্দ-পারের বাংলা কবিতার হারানো নোলক। নিজেরই সঙ্গে সংঘাতে গিয়ে আপনি দেখান, কবিতা থেকে মতবাদ আর রাজনীতির অসূয়াকেও সরাতে পারেন জাতকের হংসের মতো। দুধসাগর থেকে পানি ঝেড়ে শুধু ননি নিতে আপনি পারেন। লিখতে পারেন এমন অনায়াস আবেশে,

‘কী প্রপঞ্চে ফিরে আসি, কী পাতকে
বারম্বার আমি
ভাষায়, মায়ের পেটে
পরিচিত, পরাজিত দেশে?
বাক্যের বিকার থেকে তুলে নিয়ে ভাষার সৌরভ
যদি দোষী হয়ে থাকি সেই অপরাধে
আমার উৎপন্ন হউক পুনর্বার তীর্যক যোনিতে।
অন্তত তাহলে আমি জাতকের হরিণের মত
ধর্মগণ্ডিকায় গ্রীবা রেখে
নির্ভাবন দেখে যাবো
রক্তের ফিন্‌কিতে লাল হয়ে
ধুয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ নির্ভয়ে, নির্বাণে।’ (জতিষ্মর, সোনালি কাবিন)

কবিতার প্রাণভোমরা চলে গেছেন, আজ আর গান হবে না। আজ শুধু রোদন, আজ শুধু আল মাহমুদকে আবাহন। বিদায় বাংলা কবিতার সন্তপুরুষ, কৌম সমাজের শেষ কবি! ভাষার জননীর গর্ব আপনি। আপনাকে ওরা নিক বা না নিক, শহীদ মিনারে মা চার সন্তানকে নিয়ে আপনার জন্যই অপেক্ষা করছে। আপনাকে শেষ দেখা দেখবে বলেই সোনার নোলক হারানো দুঃখিনী মায়ের মাথাটা আরেকটু নত হয়ে আছে।

ফারুক ওয়াসিফ: লেখক ও কবি