সবক শুনতে হয়, অবাক লাগে: যুক্তরাষ্ট্র প্রসঙ্গে হাসিনা

সবক শুনতে হয়, অবাক লাগে: যুক্তরাষ্ট্র প্রসঙ্গে হাসিনা

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, আমেরিকার মতো জায়গা, যারা সব সময় ন্যায়বিচারের কথা বলে, গণতন্ত্রের কথা বলে, ভোটাধিকারের কথা বলে, তারা মানবাধিকারের কথা বলে, কিন্তু আমাদের যে মানবধিকার লঙ্ঘন হয়েছিল, আমরা যে ন্যায়বিচার পাইনি... তারপর যখন এই বিচার হলো, সেই খুনিদের আশ্রয় দিয়ে বসে আছে। নূরকে আশ্রয় দিয়ে রেখেছে কানাডা, আর খুনি রাশেদ এখনও আমেরিকায়।

তিনি বলেন, তাদের কাছ থেকে আমাদের আইনের শাসনের সবকও শুনতে হয়, গণতন্ত্রের কথাও শুনতে হয়, ন্যায়বিচারের কথাও শুনতে হয়- সেটিই আমার কাছে অবাক লাগে।

মঙ্গলবার বিকালে সুপ্রিম কোর্ট প্রকাশিত ‘বঙ্গবন্ধু ও বিচার বিভাগ ও ‘বঙ্গবন্ধু অ্যান্ড জুডিসিয়ারি’ শীর্ষক বাংলা ও ইংরেজিতে মুজিব স্মারক গ্রন্থ এবং ‘ন্যায়কণ্ঠ’ শীর্ষক মুজিববর্ষের স্মরণিকার মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে ভিডিও কনফারেন্সে যুক্ত হয়ে তিনি এসব কথা বলেন।

প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানের বিশেষ অতিথি আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ভার্চুয়ালি এবং মুজিববর্ষ উদযাপন সংক্রান্ত সুপ্রিম কোর্ট জাজেস উপ-কমিটির আহবায়ক আপিল বিভাগের বিচারপতি মো. নুরুজ্জামানও বক্তব্য রাখেন।

অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু হত্যা পরবর্তী বিচার বিভাগ ও খুনিচক্রের পৃষ্টপোষকদের ভূমিকা তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

খুনিদের ফিরিয়ে আনতে সরকারের প্রচেষ্টা চালানোর কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমি সরকারে আসার পর থেকে (যুক্তরাষ্ট্রে) যতজন রাষ্ট্রপতি এসেছেন, প্রত্যেকের কাছে বারবার অনুরোধ করেছি যে একটা সাজাপ্রাপ্ত আসামিকে আপনারা কিভাবে আশ্রয় দেন, আপনাদের জুডিশিয়ারি কিভাবে আশ্রয় দেয়, কিভাবে আপনারা একটা খুনিকে আশ্রয় দেন? তাকে (রাশেদ) আজ পর্যন্ত ফেরত দিল না।’

১৯৭৫ সালের ১৫ই আগষ্টের বিয়োগান্তক অধ্যায় তুলে ধরে দীর্ঘদিন বিচার না পাবার জন্য আক্ষেপ প্রকাশ করেন শেখ হাসিনা।

ছয় বছর প্রবাসে জীবন কাটাতে বাধ্য হবার পর আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হলে দেশে ফিরে আসেন শেখ হাসিনা এবং ১৯৯৬ সালের আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলেই ‘ইনডেমনিটি অ্যাক্ট’ বাতিল করে জাতির পিতা হত্যাকান্ডের বিচারের পথ সুগম হয়।

এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আসলে বহু বছর বিচার না পেয়ে মনে অনেক দুঃখ ছিল। যা হোক, এই হত্যার বিচার পেয়েছি। এটাই হচ্ছে সব থেকে বড় কথা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যার রায় কার্যকর হওয়ায় বিচার বিভাগ, দল ও দেশবাসীর প্রতিও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন তিনি।

তিনি বলেন, তবে এখন আরেকটা দায়িত্ব রয়ে গেছে। চক্রান্তটা খুঁজে বের করা। এটা একদিন বের হবে। এতে কোন সন্দেহ নেই।

তার সরকার ক্ষমতায় না এলে বা তিনি বেঁচে না থাকলে এদেশে কোনদিন বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের বিচার হতো কি না তা নিয়েও সংশয় প্রকাশ করে তিনি বলেন, তখন গণতন্ত্র, মৌলিক অধিকার বা মানবাধিকারটা কোথায় ছিল। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় না এলে দেশে সেই ইনডেমনিটি বা সেই বিচারহীনতার সংস্কৃতিই থেকে যেত।

‘বাবার হত্যাকান্ডের বিচার চাইতে মামলা করার জন্য তাকে, তার মতন আপনজন হারাদের ক্ষমতায় আসতে হয়েছে’, উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে আমার বিচার পাওয়ার অধিকার হরণ করা হয়েছিল এবং আমরা সরকারে আসার পরই এই বিচার সম্পন্ন হয়েছে। যদিও এই বিচারের রায় দিতে গিয়ে বা বিচার করতে যেয়ে উচ্চ আদালতে অনেকেই সেই সাহসটা পাননি, একটা পর্যায়ে সরে গেছেন।’

খুনীদের বিভিন্ন দেশে পলাতক থাকা প্রসংগে তিনি বলেন, এখনও কয়েকজন খুনী পালিয়ে আছেন, তাদেরকেও খোঁজা হচ্ছে।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘সব থেকে বড় কথা হচ্ছে যে, আমেরিকার মত দেশ সবসময় ন্যায়বিচার এবং গণতন্ত্রের কথা বলে, ভোটাধিকারের কথা বলে, মানবাধিকারের কথা বলে। কিন্তু আমাদের যে মানবাধিকার লঙ্ঘন হয়েছিল, আমরা যে ন্যায় বিচার পাইনি- তারপরে যখন বিচার হলো, সেই খুনীদের আশ্রয় দিয়ে বসে আছে।’

তিনি সরকারে আসার পর যুক্তরাষ্ট্রে যে কজন রাষ্ট্রপ্রধান ক্ষমতায় এসেছেন তাদের কাছে খুনীদের ফেরত পাঠানোর বিষয়ে কথা বলেছেন, অনুরোধ করেছেন উল্লেখ করে সরকার প্রধান বলেন, ‘আমি বার বার বলেছি একজন সাজাপ্রাপ্ত আসামীকে আপনারা কিভাবে আশ্রয় দেন। আপনাদের জুডিসিয়ারি কিভাবে একজন খুনীতে আশ্রয় দেয়?’

আমেরিকায় খুনী রাশেদ এবং কানাডায় মেজয় নূর আশ্রয় নিয়ে আছেন বলেও তিনি জানান।

অনুষ্ঠানে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, ‘বিচারব্যবস্থা ও আদালতের প্রতি বঙ্গবন্ধুর আস্থা ছিল অবিচল। এ কারণেই বঙ্গবন্ধু দেশ স্বাধীন হওয়ার পরপরই দেশের সংবিধান প্রণয়ন করেন। নানা প্রতিকূলতা সত্ত্বেও অতীতের সব গ্লানি মুছে ফেলে সুপ্রিম কোর্ট বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলাসহ এ ধরণের মামলাগুলো নিষ্পত্তি করে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় বিচার বিভাগ সংবিধান সমুন্নত রেখে কাজ করে যাচ্ছে। বিচার বিভাগ জনগণের আস্থাস্থল হিসেবে পরিণত হয়েছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে স্মারক গ্রন্থ প্রকাশ করে, বঙ্গবন্ধুর প্রতি প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করে বিচার বিভাগ বঙ্গবন্ধুকে আরও মহিমান্বিত করেছেন।’

এর আগে স্বাগত বক্তব্যে বিচারপতি মো. নুরুজ্জামান বলেন, বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে প্রকাশিত তিনটি স্মারক গ্রন্থ বিচার বিভাগের ইতিহাসে অনন্য মাইলফলক হয়ে থাকবে।

সভাপতির বক্তৃতায় প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ একে অপরের পরিপূরক যার একটিকে বাদ দিয়ে এই বাংলাদেশ কল্পনা করা যায় না। বিংশ শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ এ ব্যক্তিত্বেও জীবন ছিল কণ্টকাকীর্ণ ও দুঃসহ। বঙ্গবন্ধু জীবনের মূল্যবান অনেক সময় কারাভোগ করেছেন, তার অনেকটা সময় আইন-আদালত মামলা- মোকদ্দমায় কেটেছে। সেই নথিপত্রের অনেক তথ্যাদি বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে সুপ্রিম কোর্ট প্রকাশিত স্মারক গ্রন্থে উঠে এসেছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘শোষণ বঞ্চনার বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর নির্ভীক অবস্থানের কারণে তিনি শোষিত ও নির্যাতিত বিশ্ব মানব সমাজের সকল আন্দোলনের অনুপ্রেরণা ও অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে প্রাতঃস্মরণীয় ও অনুকরণীয় হয়ে থাকবেন।’

অনুষ্ঠানে স্মরকগ্রন্থের তথ্যাদি নিয়ে সংক্ষিপ্ত তথ্যচিত্র প্রদর্শন করা হয়। এর আগে অনুষ্ঠানের শুরুতে উপস্থিত সবাই জাতির পিতা ও বঙ্গমাতাসহ ’৭৫ এর ১৫ আগস্টের সব শহীদ এবং বিজয়ের এই মাসে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে দাঁড়িয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করেন।