শোকে স্তব্দ নারায়ণগঞ্জ

শোকে স্তব্দ নারায়ণগঞ্জ নারায়ণগঞ্জে মসজিদে বিস্ফোরণের ঘটনায় নিহত রিফাতের মা–বোনের আহাজারি। ছবি: সংগৃহীত

নারায়ণগঞ্জের পশ্চিম তল্লার বাসিন্দা রীনা বেগম এখনো ছেলে আসিফুর রহমান রিফাতের (১৮) মৃত্যুর খবর জানেন না। শুক্রবার বিস্ফোরণের ঘটনার পর থেকেই ছেলের বিছানায় বসে বিলাপ করে যাচ্ছেন। বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন, জ্ঞান ফিরলে আবার বিলাপ করছেন। মাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে চলেছেন রিফাতের দুই বোন পলি ও ডলি। আর মাকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন, আদরের ভাইয়ের কিছু হয়নি। সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে।

কিন্তু প্রতিবেশীরা জানেন কিছু আর ঠিক হবে না। মা-বোনকে ছেড়ে চিরদিনের মতো চলে গেছেন রিফাত। এ তথ্য জেনে প্রতিবেশীরা রিফাতদের বাড়িতে ভিড় জমিয়েছেন। রিফাতের মাকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন। সান্ত্বনা দিতে গিয়ে ফেলছেন চোখের জল।

নারায়ণগঞ্জের পশ্চিম তল্লা এলাকার রোকসানা খাতুনের বাড়িতে ভাড়া থাকেন নারায়ণগঞ্জ কলেজের উচ্চ মাধ্যমিকের ছাত্র রিফাতের পরিবার। রিকশাচালক বাবা আনোয়ার হোসেনের পক্ষে ছয় সদস্যের পরিবারের খরচ মেটানো সম্ভব হয় না বলে টিউশনি করতেন রিফাত। তাদের বাসা থেকে ১০০ গজ দক্ষিণেই বায়তুস সালাত জামে মসজিদ।

শনিবার সকালে ওই এলাকার অলি-গলিগুলোতে ছিলো হাজারো মানুষের ভিড়। ক্লাব ও পাড়া মহল্লাগুলোতে কালো কাপড় ঝোলানো হয়েছে। স্বজনহারাদের আহাজারি চলছে প্রায় প্রতিটি বাড়িতে। যাদের কেউ হতাহত হননি, তাঁরাও সহ্য করতে পারছেন না একসঙ্গে এত মৃত্যু ও দগ্ধের ঘটনা। হঠাৎ প্রতিবেশীদের এমন পরিণতিতে অঝোরে কাঁদছেন তাঁরা। আহতদের সুস্থতার জন্য প্রার্থনা করছেন।

বিস্ফোরণে হতাহত অধিকাংশ মুসল্লির বাড়ি মসজিদের গা ঘেঁষে পশ্চিম দিকে চলে যাওয়া সরু সড়কটির আশপাশে। এ সড়ক ধরে ২০ গজ এগিয়ে গেলেই ব্যবসায়ী আবদুল কুদ্দুস ব্যাপারীর (৬৫) বাড়ি। বিস্ফোরণে আহত হওয়ার পর চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনিও মারা গেছেন। শনিবার সকাল ৯টায় বৃদ্ধের মৃত্যুর খবর জানতে পেরে কান্নায় ভেঙে পড়েন তাঁর স্বজনেরা। বাবার মৃত্যুর খবরে মাটিতে গড়াগড়ি করে কাঁদছিলেন তাঁর চার মেয়ে।

কুদ্দুস ব্যাপারীর বাড়ির দেয়াল ঘেঁষেই খান ভিলা। এই বাড়ির একটি টিনশেড ঘরে পরিবার নিয়ে ভাড়া থাকতেন হাফেজ ইব্রাহিম বিশ্বাস (৪২)। স্থানীয় একটি পোশাক কারখানায় কাজ করে পড়াশোনা করাতেন দুই ছেলে-মেয়েকে। শনিবার সকালে তাঁর বাড়িতে গিয়ে কাউকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। প্রতিবেশীরা বলেন, রাতেই ইব্রাহিমের মৃত্যুর খবর জেনেছেন তাঁরা। স্বামীর লাশ নিয়ে বরিশালে গ্রামের বাড়িতে রওনা দিয়েছেন ইব্রাহীমের স্ত্রী।

নারায়ণগঞ্জে মসজিদে বিস্ফোরণের ঘটনায় দুই ভাই সাব্বির ও জুবায়ের নিহত হয়েছেন। ভাইদের জন্য কাঁদতে কাঁদতে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে ছোট ভাই ইয়াসিন।

ইব্রাহীমের বাড়ি থেকে ৩০ গজ এগিয়ে গেলেই বোমালা মাঠ। এই মাঠের পাশে নূরজাহান বেগমের বাড়িতে তিন ছেলেকে নিয়ে ভাড়া থাকেন পারুল বেগম। অনেক আগেই স্ত্রী-সন্তানদের ছেড়ে চলে যান নুরুদ্দীন। পেশায় আরবির শিক্ষক পারুল প্রাইভেট পড়িয়ে বড় করছিলেন তিন ছেলেকে। বিস্ফোরণের সময় পারুল বেগমের তিন ছেলে সাব্বির (২১), জোবায়ের (১৮) ও ইয়াসিন (১০) ছিলেন মসজিদে। ভাগ্যক্রমে তাঁর ছোট ছেলে ইয়াসিন বেঁচে ফিরলেও আগুনে পুড়ে মারা গেছেন পারুল বেগমের বড় দুই ছেলে। ঘটনার পর থেকেই ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আছেন পারুল বেগম।

পারুল বেগমের বাড়ির ২০ গজ দূরে বাবা-মায়ের সঙ্গে থাকত সাত বছরের শিশু জোবায়েদ। শুক্রবার বাবা জুলহাস মিয়ার হাত ধরে মসজিদে নামাজ পড়তে গিয়েছিল সে। তারপর আর সে বাড়ি ফেরেনি। চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু হয় জোবায়েদের।

একসঙ্গে এত লাশ রাখার ব্যবস্থা নেই তল্লা এলাকায়। এই এলাকার লোকজন তাই ছুটছেন দূর-দূরান্তের মসজিদগুলোতে। খাটিয়া সংগ্রহ করে এনে রাখছেন মসজিদ থেকে ১৫০ গজ দূরের বোমালা বাড়ির মাঠে।