কাউন্সিলরের ফেসবুক পেজে লাইক দিলে আগে মিলছিল টিকা

কাউন্সিলরের ফেসবুক পেজে লাইক দিলে আগে মিলছিল টিকা

বেলা আড়াইটা। তখন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) ৩৩ নম্বর ওয়ার্ডে টিকাদান কর্মসূচি শুরু হয়। তবে এই কেন্দ্রে টিকা নিতে আসা ব্যক্তিদের মধ্যে যাঁরা স্থানীয় কাউন্সিলর আসিফ আহমেদের মুঠোফোন নম্বরে যোগাযোগ করে সিরিয়াল নিয়েছেন, তাঁরা আগে টিকা নেওয়ার সুযোগ পান। এ ছাড়া লাইনে দাঁড়ানো ব্যক্তিদের যাঁদের হাতে স্মার্টফোন ছিল, এই ব্যক্তিদের টিকা নিতে ওপরে পাঠান নিচে দায়িত্ব পালনকারী আনসার সদস্যরা।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক আনসার সদস্য বলেন, ‘তাঁরা সরাসরি কাউন্সিলরের সঙ্গে যোগাযোগ করে এসেছেন। আমাদের কিছুই করার নেই। যাঁদের হাতে স্মার্টফোন নেই, তাঁরা সবার পরে যাবেন।’

এই ওয়ার্ডের টিকা নিতে আসেন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী চান মিয়া হাউজিং সি ব্লকের বাসিন্দা আদিবা নুর। তাঁর মুঠোফোনে ওয়াটসঅ্যাপ ইনস্টল করা ছিল না। কাউন্সিলরের সহকারীরা তাৎক্ষণিক অ্যাপটি ইনস্টল করতে ইন্টারনেট সেবা দিয়ে সহযোগিতা করেন। পরে ওয়াটসঅ্যাপে তাঁকে মেসেজ পাঠাতে হয়। তখন কাউন্সিলর নিজে একটি ফেসবুক পেজের লিংক দেন। লিংকটি কাউন্সিলরের নিজের ফেসবুক পেজের। সেই লিংকে ঢুকে কাউন্সিলরের ফেসবুক পেজে লাইক দেওয়ার পর তাঁকে টিকা নেওয়ার জন্য তিনতলায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়।

কাউন্সিলর আসিফ আহমেদ বলেন, প্রথমবার গণটিকা কর্মসূচির আওতায় প্রায় ১০০ লোক আর দ্বিতীয় ডোজের টিকা নিতে আসেননি। তাই কারা টিকা নিতে আসছেন, সেই তথ্য সংরক্ষণের জন্য এই ব্যবস্থা করা হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, অনেক ধনাঢ্য ব্যক্তি এখানে টিকা দিতে আসেন। তাঁরা অনেকে নিজেদের গৃহকর্মীর সঙ্গে লাইনে দাঁড়াতে চান না। তাই তাঁরা যাতে আগে সিরিয়াল দিতে পারেন এবং লাইনে না দাঁড়িয়ে টিকা নিতে পারেন, এ জন্য এই ব্যবস্থা। এতে কারও অসুবিধা হচ্ছে না বলেও তিনি জানান।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জন্মদিন উপলক্ষে আজ মঙ্গলবার করোনার গণটিকা কার্যক্রমের আওতায় ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে (ডিএনসিসি) ৬০ হাজার টিকা দেওয়ার প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। সকাল নয়টায় টিকাদান কর্মসূচি শুরু হওয়ার কথা থাকলেও পরে তা পরিবর্তন করে বেলা আড়াইটায় নির্ধারণ করা হয়।

দুপুরে ডিএনসিসির ২৯, ৩০, ৩৩ ও ৩৪ নম্বর ওয়ার্ডের নির্ধারিত টিকাদানকেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায়, কেন্দ্রের বাইরে পৃথক দুটি লাইনে দাঁড়িয়ে নারী ও পুরুষেরা টিকা নেওয়ার জন্য অপেক্ষা করছেন। বেলা আড়াইটার পর থেকে লাইনে দাঁড়ানো লোকজনকে পর্যায়ক্রমে ৫-১০ জন কেন্দ্রের ভেতরে প্রবেশ করানো হচ্ছে। তবে বয়স্ক নারী-পুরুষ এবং সন্তান সঙ্গে করা আসা নারীদের লাইনে দাঁড়ানো ছাড়াই টিকা দেওয়ার সুযোগ করে দেওয়া হচ্ছে। কেন্দ্রে দায়িত্ব পালনকারী স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলরের স্বেচ্ছাসেবকেরা অপেক্ষমাণ লোকজনের শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণের কাজ করছেন।

যাঁদের টিকা নিবন্ধন করা ছিল, শুধু তাঁদের লাইনে দাঁড়াতে বলা হয়। নিবন্ধন ছাড়া আগের মতো যাঁরা শুধু জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি নিয়ে এসেছিলেন, তাঁদের অযথা লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা না করে নিবন্ধন করে আসতে বলা হয়। এতে দূর থেকে আসা লোকজনকেও দুর্ভোগ পোহাতে হয়।

বেলা পৌনে তিনটার ডিএনসিসির-৩৪ নম্বর ওয়ার্ডের নির্ধারিত কেন্দ্র রায়েরবাজারের কমিউনিটি সেন্টারে টিকাদান কর্মসূচি শুরু হয়। নারীদের মধ্যে প্রথম টিকা দেন বছিলার বাসিন্দা সুমাইয়া শারমিন। যদিও তিনি দুপুর ১২টার দিকে কেন্দ্রে আসেন এবং নারীদের লাইনে অন্তত ১০ জনের পেছনে ছিলেন। তবে সুমাইয়ার কোলে দুই বছর বয়সী সন্তান রাইন ছিল। আর বাসায় ছয় বছর বয়সী সন্তান রামিনকে এক আত্মীয়ের কাছে দেখভালের দায়িত্ব দিয়ে আসেন।

বিষয়টি কেন্দ্রে এসে স্বেচ্ছাসেবকদের বলার পরে তাঁকে আগে টিকা দেওয়ার সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে জানিয়ে সুমাইয়া শারমিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘কতক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা লাগবে, টিকা পেতে কয়টা বাজবে—এসব নিয়ে দুশ্চিন্তা হচ্ছিল। কিন্তু আমার সমস্যাটি বলার পর সবার আগে টিকা দেওয়ার সুযোগ পেয়ে গেলাম।’

তবে লাইনে দাঁড়ানো ব্যক্তিদের উপেক্ষা করে পৌনে তিনটা থেকে চারটা পর্যন্ত অন্তত ১০ জনকে টিকার জন্য ভেতরে ঢোকানো হয়। লাইন ছাড়া ভেতরে প্রবেশ নিয়ে এ সময় হট্টগোল করেন লাইনে দাঁড়ানো ব্যক্তিরা।

সায়েরা বেগম নামের এক নারী লাইন ছাড়াই কেন্দ্রে এসেই ভেতরে প্রবেশ করেন। সঙ্গে কার্ড না থাকায় আনসার সদস্যরা ফটকে বাধা দিলে তিনি বলেন, ‘আমার ছেলে (সজীব) ওপরে আছে। কার্ড ওর কাছেই।’ পরে সজীব নামের ওই লোক নিচে নেমে আসেন। এ সময় সজীব নিজেকে আল আমিন নামের একজনের বন্ধু হিসেবে পরিচয় দেন। আল আমিন ওয়ার্ড কাউন্সিলরের স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করছেন। আল আমিনের পরিচয়, তিনি ৩৪ নম্বর ওয়ার্ড ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক। এ বিষয়ে আল আমিনকে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, তাঁর বন্ধুর মা টিকা নিতে নয়, অন্য কাজে আসছেন। পরে অবশ্য সায়েরা বেগম প্রথম পাঁচজনের মধ্যে টিকা নেন।

এরপরে ডিএনসিসির ২৯ নম্বর ওয়ার্ডের সূচনা কমিউনিটি সেন্টার টিকাকেন্দ্র ও ৩০ নম্বর ওয়ার্ডে বাইতুল আমান হাউজিং এলাকার ১০ নম্বর সড়কের টিকাকেন্দ্রেও লোকজনকে টিকা নিতে দেখা গেছে। ৩০ নম্বর ওয়ার্ডে টিকার নিবন্ধনপত্র সঙ্গে থাকার পরেও জাতীয় পরিচয়পত্রের কপি বাধ্যতামূলক করা হয়। যাঁরা শুধু টিকার নিবন্ধনপত্র নিয়ে এসেছেন, তাঁদের এ সময় ভোগান্তিতে পড়তে হয়। অনেকে জাতীয় পরিচয়পত্রের কপি নিতে বাসায়ও ফিরে যান।