একটি আপিল নিষ্পত্তির আগে ফাঁসি কার্যকর

দায় থাকলে আইনজীবীর: আদালত

দায় থাকলে আইনজীবীর: আদালত

মোকিম ও ঝড়ু নামের দুই আসামির দুটি আপিল আবেদনের একটি নিষ্পত্তি করে রায় কার্যকর করা হলেও অপর আপিল আবেদন ঝুঁলে থাকার পেছনে দায় থাকলে তা আইনজীবীর (আসামিপক্ষের) বলে মন্তব্য করেছেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ।

সোমবার (৮ নভেম্বর) প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বাধীন পাঁচ সদস্যের আপিল বেঞ্চ এ মন্তব্য করেন।

আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে শুনানিতে ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল এএম আমিন উদ্দিন। অপরদিকে দুই আসামির আপিল আবেদনের পক্ষে শুনানিতে ছিলেন অ্যাডভোকেট মো. আসিফ হাসান।

আজ শুনানির জন্য মামলাটি আপিল বিভাগের কার্যতালিকায় ২৬ নম্বর ক্রমিকে ছিল। মামলাটির শুনানির শুরুতে অ্যাটর্নি জেনারেল আদালতকে বলেন, ‘এই মামলাটি তালিকায় আসার পর পত্র-পত্রিকায় দেখলাম, এখানে নাকি আপিল পেন্ডিং থাকা অবস্থায় ফাঁসি কার্যকর হয়েছে। এটা শোনার পরে আমরা খোঁজ নিয়ে দেখলাম— এরা একটা জেল আপিল ফাইল করেন। আমরা সে রায়ের সার্টিফায়েড কপি দেখলাম। জেল আপিলে অ্যাডভোকেট অন রেকর্ড ছিলেন অ্যাডভোকেট নাহিদ সুলতানা।’

তখন প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘এখানে আপিলকারী প্রথমজনের নাম কী?’ জবাবে অ্যাটর্নি বলেন, ‘ঝড়ু (আসামির নাম)।’

তখন প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘এ মামলার জেল আপিল নম্বর ০৩/২০১৬। শুধু তাই নয়, এ মামলার পেপারবুক তৈরি হয়েছে কোর্টের মাধ্যমে। ২০১৬ সালের ১৫ নভেম্বর শুনানি হয়েছে। পরে ওই দিনই রায় দেওয়া হয়। ১৪ পৃষ্ঠার রায় ঘোষণা হয়েছে।’

পরে প্রধান বিচারপতি আসামির দায়ের করা আপিলের অ্যাডভোকেট অন রেকর্ড সুফিয়া খাতুনকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘আপনি কি এটা জানেন না? যখন জেল আপিল করে, তখন একটা আবেদন দিয়ে দুটি একসঙ্গে কনভার্সন করে নিতে হয় যে, আমরা রেগুলার (নিয়মিত) আপিল করছি, আমাদের এটা কনভার্ট করে নেন।’

জবাবে আইনজীবী সুফিয়া খাতুন বলেন, ‘এ মামলায় ক্লায়েন্ট আমার সঙ্গে কোনও যোগাযোগ করেননি। কোনও ফাইল দেননি। মামলা যিনি দিয়েছেন তাকে যথা সময়ে জানিয়েছি। কিন্তু তারপর আর কোনও সাড়া পাওয়া যায়নি।’

তখন আইনজীবী মো. রুহুল আমিন তুহিন এ মামলার আইনজীবী বলে আদালতকে জানান। তিনি ছাড়া আর কোনও মক্কেলের সঙ্গে যোগাযোগ হয়নি। আসামির পরিবারের কারও সঙ্গে যোগাযোগ হয়নি। তাছাড়া দুটি আপিল হলে সেকশনই তো যোগ করে দেয়।

এসময় প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘সেকশন তো যোগ করে না। আমাদের এখানে তো ডিজিটাল সিস্টেম না। বরং আপিলকারী আইনজীবী এসে বলেন যে, এটা ওইটার সঙ্গে (একটির সঙ্গে অন্যান্য আপিল আবেদন) ট্যাগ করেন। মামলায় মক্কেলদের সঙ্গে যখন যোগাযোগ থাকে তখনই আমরা এলার্ট হই।’

জেল আপিলে অ্যাডভোকেট অন রেকর্ডে নাহিদ সুলতানা কীভাবে হলেন তা জানতে প্রশ্ন করেন অ্যাটর্নি জেনারেল। প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘এটা হয়তো কোর্ট থেকে নিয়োগ (দুস্থ আসামির ক্ষেত্রে) দিয়েছে।’

সুফিয়া খাতুন বলেন, ‘এটা তাহলে নাহিদ সুলতানারও দায়িত্ব ছিল আপিলের বিষয়টি বলে দেওয়া।’

এ সময় অ্যাটর্নি জেনারেল জেল আপিলে আইনজীবী নাহিদ সুলতানা কী বক্তব্য আদালতে দিয়েছিলেন সেটা পড়ে শোনান।

পরে আসামিপক্ষের আইনজীবী আসিফ হাসান আদালতে যুক্ত হয়ে কথা বলার সুযোগ চান।

অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘এ মামলায় আপিল বিভাগে রায় হয়েছে ২০১৬ সালের ১৫ নভেম্বর। ২০১৭ সালের ২২ অক্টোবর রাষ্ট্রপতি ক্ষমা প্রত্যাখ্যান করলেন। আর কারা কর্তৃপক্ষ তার পরিবারকে দেখা করার জন্য চিঠি দিলো ২০১৭ সালের ১২ নভেম্বর। চিঠির পর তাদের পরিবারের সদস্যরা সাক্ষাৎও করেছেন। রায় কার্যকর হলো ১৭ নভেম্বর। রায়ের এক বছর পরে কারা কর্তৃপক্ষ তাদের চিঠি দেয়। এই এক বছর পর্যন্ত আসামিপক্ষের আইনজীবীরা কিছুই করলেন না। এতটা সময় পেলো, তারপরও তার কোনও আইনজীবী কিছুই জানাননি।’

তখন আসামিপক্ষের আইনজীবী আসিফ হাসান বলেন, ‘গত দুই সপ্তাহ আগে আইনজীবী হুমায়ুন কবির আমাকে এ মামলায় যুক্ত করেন। তিনি এ মামলাটি করে দিতে বলেন। পরে আমি তাকে বললাম, তুমি মামলার আসামিদের পরিবারের খোঁজ নাও। আমি একটু পড়ে দেখি। এরপর মামলাটি নিয়ে আমি প্রস্তুত হলাম। ওই দিন রাতে আইনজীবী হুমায়ুন কবির আমাকে জানান, এ মামলায় আসামিদের সাজা কার্যকর হয়ে গেছে। আইনজীবী হুমায়ুন কবির ওই এলাকার বাসিন্দা। তিনি আপিলে এনরোল না থাকায় ২০১৩ সালে আইনজীবী নওয়াব আলীকে দিয়ে ফাইল করেছিলেন। তিনি তো নেই (মারা গেছেন)।’

আসিফ হাসান আরও বলেন, ‘ফাঁসি কার্যকরের বিষয়টি শুনে আমি বললাম অসম্ভব, এটাতো হতে পারে না। আপিল পেন্ডিং থাকা অবস্থায় এটা (মৃত্যুদণ্ড) কীভাবে কার্যকর হয়? তখন আমি হুমায়ুন কবিরকে বললাম— তুমি আরও খোঁজ নাও। তারপর বার বার খোঁজ নেওয়ার পরে তিনি নিশ্চিত হলেন যে, আসামিদের ফাঁসি কার্‌্যকর হয়ে গেছে। তখন আমি তাকে বললাম— ঠিক আছে আমি কোর্টকে জানাই। এটা তো হতে পারে না। শত বছরেও এমনটি হয় না। পরবর্তীতে পত্র-পত্রিকা ও অ্যাটর্নি জেনারেলের কাছ থেকে জানলাম— এটাতে (মামলায়) জেল আপিল হয়েছে। আসামির পরিবারের সদস্যরা অশিক্ষিত, অজপাড়াগাঁয়ের। তারা জেল আপিল কী তাও মনে হয় বুঝে না। তারা নাকি জেলখানায় গিয়েছিল, আসামিদের সঙ্গে দেখা করে কান্না করতে করতে বাড়ি চলে গেছে।’

এ সময় আপিল বিভাগের বিচারপতি ওবায়দুল হাসান বলেন, ‘মিস্টার আসিফ বলেন তো দেখি, এখানে প্রসিডিউর মেনটেইন করা হয়েছে কিনা?’

জবাবে আইনজীবী আসিফ বলেন, ‘মাই লর্ড একটু… আছে। যেহেতু আমাদের (আপিল বিভাগের) কোর্টের একটা রুলস আছে।’

বিচারপতি জানতে চান, ‘আপিল শুনানি শেষে রায়, রাষ্ট্রপতির ক্ষমা সব কিছু হয়েছে কিনা?’ আইনজীবী বলেন, ‘এগুলো হয়েছে। তবে কারা কর্তৃপক্ষের আরও সতর্ক হওয়া উচিত ছিল। কারণ হচ্ছে সুপ্রিম কোর্ট রুলস অনুযায়ী নিশ্চয় বর্তমান আপিলের নোটিশটা অবশ্যই জেলখানায় গিয়েছে। ২০১৩ সাল থেকে ফাঁসি কার্যকর পর্যন্ত চার বছরে এটা পৌঁছাবে না, এটা অসম্ভব ব্যাপার। এটা তো অবশ্যই গেছে। তাদের উচিত ছিল, যেখানে একজন মানুষের জীবন নিচ্ছে তাদের সতর্ক হওয়া।’

তখন বিচারপতি ওবায়দুল হাসান বলেন, ‘তাদের যেমন উচিত ছিল, অ্যাডভোকেটের কি উচিত ছিল না? যখন জেল আপিল নিষ্পত্তি হয়ে গেলো। এটা তো আমরা জানতে পারিনি। কেউ জানায়নি।’

এ সময় আপিল বিভাগের বিচারপতি নূরুজ্জামান বলেন, ‘আপিলটা ফাইল করেই তো আপনারা একটা দরখাস্ত করবেন স্টে (মৃত্যুদণ্ড স্থগিত রাখার) নেওয়ার জন্য।’

আইনজীবী বলেন, ‘মাই লর্ড, আমরা ফাইল করলেই ধরে নেই যে ইনফর্ম (স্থগিত) হয়ে গেছে।’

বিচারপতি বলেন, ‘তাহলে স্টে করার বিষয়টি কেন আসে?’

প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘আপনার অ্যাডভোকেট অন রেকর্ড আইনজীবীর বক্তব্য হলো তার সঙ্গে কেউ যোগাযোগই করেনি।’

বিচারপতি ওবায়দুল হাসান বলেন, ‘গতকাল (রবিবার) একটা মামলায় রাষ্ট্রপতি এরই মধ্যে তার ক্ষমার আবেদন খারিজ করে দিয়েছেন। তারপরও আইনজীবী যখন বিষয়টি জানালেন— আমরা কিন্তু তখন ফাঁসি কার্যকর স্থগিতের আদেশ দিয়েছি, রিভিউ দেখবো বলে। একটা মানুষের ফাঁসি হয়ে যাবে, আমরাই হয়তো আদেশ দিয়েছি। কিন্তু শেষ চেষ্টা তাকে করতে দেওয়া উচিত।’

প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘আপিল বিভাগে এনরোল না হয়েও যখন অন্য একজনকে দিয়ে মামলা ফাইল করেছেন, তখন তিনি যদি আপিলের পদ্ধতি না জানেন, তখন মহামুশকিলের কথা।’

আইনজীবী আসিফ বলেন, ‘আমরা যখন আপিল ফাইল করি, তখন অটোমেটিক্যালি ফাঁসির কার্যক্রম স্থগিত হয়ে যায়। এটা অর্ডার ২৪ রুলস ৫ এ আছে। মানুষের ভুল হতেই পারে। পৃথিবীতে এমন কেউ নেই যার ভুল হয় না। এটা হতেই পারে। কিন্তু আমাদের চাওয়া হচ্ছে— জেল কর্তৃপক্ষ আরও সতর্ক হোক। তাদের আরও একটু যাচাই-বাছাই করা উচিত ছিল।’

প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘জেল আপিল তো মেরিটে শুনানি হয়েছে।’

আইনজীবী বলেন, ‘ঠিক আছে, তবে দুটি (দুটি আপিল) ট্যাগ হওয়া উচিত ছিল।’

প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘আমরা যখন আইজীবী ছিলাম জেল আপিল যখন থাকে, আমরা তখন সেটি কনভার্ট করেছি। এই প্রাক্টিস তো এখন টোটাল বন্ধ হয়ে গেছে।’

আইনজীবী বলেন, ‘এটা মাই লর্ড এখনও করছি। যখন জানতে পারি জেল আপিল আছে, তখন সেটি ট্যাগ করে দেয়। সময়মতো আমাদের আপিলটা ফাইল হয়েছে। তারপরও কেন এমনটি হলো? তারপরও কষ্ট হচ্ছে— মানুষের জন্য কিছু করতে পারলাম না। আমরা দুজন মানুষের জন্য চেষ্টা করতাম। জেল আপিলের আমরা কিছুই পাইনি।’

তখন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল বশির আহমেদ বলেন, ‘এটা রিপোর্টেড রায়। রায়টি ৫৯ ডিএলআরে আছে।’

আইনজীবী বলেন, ‘মাই লর্ড এ বিষয়ে একটা গাইড লাইন দিয়ে দেন। সাথে সাথে এই গরিবদের জন্য যদি কোনও ক্ষতিপূরণ দেওয়া যায়।’

বিচারপতি ওবায়দুল হাসান বলেন, ‘এই ক্ষতিপূরণ কিসের জন্য?’

বিচারপতি নূরুজ্জামান বলেন, ‘যে আইনজীবী ভুল করেছেন তাকে বলেন। তিনি কিছু দিয়ে দিক। এটা তো কথা না।’

বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী আইনজীবী আসিফ হাসানের কাছে জানতে চান, ‘জেল কর্তৃপক্ষের দোষটা কোথায়? আপিল বিভাগ থেকে অন মেরিটে জাজমেন্ট হয়েছে, সেটা কমিউনিকেশন হইসে, রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা প্রার্থনা খারিজ হয়েছে, পরে রায় কার্কর করা হয়েছে ‘

আইনজীবী আসিফ হাসান তখন বলেন, ‘আইনগত কোনও ভুল নাই।’

হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী তখন বলেন, ‘তাহলে জেল কর্তৃপক্ষকে দায়ী করছেন কেন?’

আসিফ হাসান বলেন, ‘বাংলাদেশে এই ধরনের মানুষের জন্য… সামনে নেওয়া উচিত। এরা (আসামিদের পরিবার) অশিক্ষিত, মুর্খ।’

বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী বলেন, ‘যেহেতু মামলা লিস্টে (কার্যতালিকায়) আসছে, শুনানি হয়েছে, উচিত ছিল অ্যাপিয়ার করা। জেল আপিলের সাথে এটা ট্যাগ করে দিতে পারতেন। আপনারা (আইনজীবী) দোষটা স্বীকার করেন না কেন? ’

আসিফ হাসান বলেন, ‘এমন একটা মক্কেল, এমনিই মুর্খ এবং গরিব মানুষ এরা, আইনজীবীকে জানায়ওনি কখনও যে, জেল আপিল হয়েছে বা করেছে তারা। আদৌ তারা জেল আপিল বোঝে কিনা সন্দেহ আছে।’

বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী বলেন, ‘এটা তো কোনও ব্যাখ্যা না। জেল আপিল হয়েছে, শুনানি হয়েছে, রিপোর্টেড হয়েছে।’

আসিফ হাসান বলেন, ‘আইনগতভাবে সবই ঠিক আছে।’

বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী বলেন, ‘রায় হওয়ার সাথে সাথে এই আপিলটা (ফৌজদারী আপিল) ইনফ্রাকচ্যুয়াস (অকার্যকর) হয়ে গেছে।’

বিচারপতি ওবায়দুল হাসান আইনজীবী আসিফ হাসানকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘আমরা সবাই আইনজীবী থেকে এখানে এসেছি। প্রধান বিচারপতি থেকে শুরু করে সবাই আইনজীবী ছিলেন। যার অবহেলা (ফাঁসি কার্যকর হওয়া ব্যক্তির ফৌজদারি আপিল কার্যতালিকায় আসার ক্ষেত্রে) সে আইনজীবী। যার জীবন গেলো সে অভিযুক্ত এবং দণ্ডিত। নিচের আদালতে দণ্ডিত, আপিল বিভাগেও দণ্ডিত সব ধরনের প্রক্রিয়ায়। জেলখানায় তাদের স্বজনরা দেখা করলো, সবকিছুই হলো, পত্রিকায় যেভাবে নিউজটা আসলো! আপনাদের এগিয়ে (আপিল বিভাগে) আসা উচিত ছিল। এগিয়ে এসে বলা উচিত ছিল ঘটনাটা এরকম।’

আইনজীবী আসিফ হাসান এ সময় বলেন, ‘সেটি বলার জন্যই আমি অপেক্ষা করছি।’

বিচারপতি ওবায়দুল হাসান বলেন, ‘আপনারা কিছুই করেননি। আমরাও অ্যাডভোকেট ছিলাম। আজকে আপনি বলছেন জেলখানা কর্তৃপক্ষকে দায়ী করা, তাদের সতর্ক করা। তারা যথেষ্ট সতর্ক থাকে, তারা কিন্তু বিষয়গুলোকে ফলো করে এবং তাদের রেকর্ড ঠিক থাকে। দেখেছি, রেকর্ডে খুব একটা ভুল হয় না। আমাদের ভুলের কারণে, আমাদের বলতে অ্যাডভোকেটদের ভুলের কারণে অনেক সময় এরকমটা হয়। আমরা (বিচারপতিরা) কোর্টে বসে থাকি, আডভোকেট অন রেকর্ডরা আসেন না। বারবার বলা হচ্ছে, অ্যাডভোকেট অন রেকর্ডরা আসেন না। কী ধরনের দায়িত্ব বলেন?’

আইনজীবী আসিফ হাসান বিচারপতির কথায় সমর্থন জানিয়ে বলেন, ‘জ্বি, এরকম হচ্ছে।’

বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী আইনজীবী আসিফ হাসানের কাছে জানতে চান— ‘জেল কর্তৃপক্ষের দোষটা কোথায়?’

অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন বিচারপতিদের উদ্দেশ করে বলেন, ‘আপনারা অন্তত রায়টা (আপিল বিভাগের) তো দেখেছেন, অ্যাডজাস্টিং জাজমেন্ট (সমন্বিত রায়)। জবানবন্দি বিশ্লেষণ করা হয়েছে।’

এ সময় প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন বলেন, ‘আচ্ছা আগামীকাল (মঙ্গলবার) এটা থাকুক। আগামীকাল এক নম্বরে (কার্যতালিকায়) থাকবে এটা।’

প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘বলা হয়েছে যে,আপিল বিচারাধীন থাকা অবস্থায় ফাঁসি কার্যকর হয়েছে। সাথে সাথে অ্যাটর্নি জেনারেল সাহেব খবর নিলেন, আমার এখানে আসলেন, রাতে।’

অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন বলেন, ‘আমি সাথে সাথে জেল কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করেছি। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রলায়ের সাথে যোগাযোগ করেছি। উনারা আমাকে একদম চার্জশিট পাঠিয়েছে, নাম্বার পাঠিয়েছে, আপনাদের আদেশ দেখেছি। দেখলাম যে, না এটা ঠিক না, যেভাবে আসছে এটা ঠিক না। সাংবাদিকদের প্রপার ইনফরমেশন দেওয়া হয় নাই।’

এ সময় বিচারপতি নূরুজ্জামান বলেন, ‘এক মানুষ এটা (আপিল বিচারাধীন থাকা অবস্থায় আসামির ফাঁসি কার্যকরের খবর) পত্রিকায় দেখে আমাদেরকে, কোর্টকে কত সমালোচনা করেছে। তারা কি ভেতরের এসব ঘটনা জানে? টকশোতে কত কথা বলা হচ্ছে।’

বিচারপতি ওবায়দুল হাসান বলেন, ‘কেন করবে না, টকশো হয়েছে।’

আইনজীবী আসিফ হাসান বলেন, ‘এসব (জেল আপিল নিষ্পত্তির পর রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা প্রার্থনার আবেদন নাকচের পর ফাঁসি কার্যকর করার কথা) কারোই জানা ছিল না।’

বিচারপতি ওবায়দুল হাসান বলেন, ‘অ্যাটর্নি জেনারেল সাহেব আপনার কলিগরা, অ্যাডভোকেট সাহেবরা, তারা কমেন্ট করতেছেন। তারা কোনও কিছু না দেখে কমেন্ট করতেছেন, এটা কি ঠিক হলো?’

এরপর প্রধান বিচারপতি সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে আপিল বিভাগের দিনের কার্যক্রম শেষ করেন।

প্রসঙ্গত, ১৯৯৪ সালের ২৮ জুন চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গায় সাবেক ইউপি সদস্য মো. মনোয়ার হোসেন খুন হন। ওই ঘটনায় তার চাচাতো ভাই মো. অহিমউদ্দিন বাদী হয়ে ২৬ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন। মামলার এজাহারে মোকিম ও ঝড়ুর নাম আসে। পরে ২০০৮ সালের ১৭ এপ্রিল এ মামলার বিচারে তিন জনের মৃত্যুদণ্ডাদেশ, দুই জনকে যাবজ্জীবন ও অপর আসামিদের খালাস দেন চুয়াডাঙ্গার অতিরিক্ত দায়রা জজ আদালত-২। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তরা হলেন— একই ইউনিয়নের তৎকালীন চেয়ারম্যান আবুল কালাম আজাদ, মোকিম ও ঝড়ু।

বিচারিক আদালতের রায়ের পর নিয়ম অনুসারে আসামিদের মৃত্যুদণ্ডাদেশ অনুমোদনের জন্য মামলাটি হাইকোর্টে আসে। মামলার ডেথ রেফারেন্স নম্বর ছিলো ৩৯/২০০৮। শুনানি নিয়ে হাইকোর্ট মোকিম ও ঝড়ুর মৃত্যুদণ্ডাদেশ বহাল রেখে ২০১৩ সালের ৭ জুলাই ও ৮ জুলাই মামলার রায় ঘোষণা করেন। বাকি আসামিদের খালাস দেন হাইকোর্ট।

পরে মোকিম (আপিল নং- ১১১/২০১৩) ও ঝড়ু (আপিল নং- ১০৭/২০১৩) সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে আপিল (জেল আপিল ও নিয়মিত আপিল) দায়ের করেন। তবে নিয়ম অনুসারে দুটি আপিল একসঙ্গে ট্যাগ না হওয়ায় শুধু জেল আপিল নিষ্পত্তি করে ২০১৭ সালে দুই আসামির মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। তবে তাদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের প্রায় ৪ বছর পর অপর মামলাটি আপিল বিভাগের কার্যতালিকায় উঠলে আপিল নিষ্পত্তির আগেই দুই আসামিকে ফাঁসি দেওয়া নিয়ে আলোচনা ওঠে।