নবীন শিক্ষার্থীদের আতঙ্ক ঢাবি’র ‘গেস্টরুম’

নবীন শিক্ষার্থীদের আতঙ্ক ঢাবি’র ‘গেস্টরুম’

‘ভাইকে যেখানেই দেখবি, সালাম দিবি’ কিংবা ‘হ্যান্ডশেকের সময় ভাইয়ের হাতে চাপ দেওয়া যাবে না’—যাঁরা ভাবছেন কোনো নাটক বা চলচ্চিত্রের সংলাপের কথা বলা হচ্ছে, তাঁরা ভুল করছেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের আবাসিক হলগুলোর অতিথিকক্ষে (গেস্টরুম) ছাত্রলীগ পরিচালিত নিয়মিত কর্মসূচির ‘শিক্ষা’ এসব। এই শিক্ষার মধ্যে আরও আছে ‘ভাইদের কাছ থেকে ছুটি নিবি’। পরীক্ষা, অসুস্থতা বা জরুরি কোনো কাজ থাকলে ‘বড়’ ভাইদের কাছ থেকে ছুটি নিতে হবে।

বাধ্যতামূলক এই ‘শিক্ষার’ মুখোমুখি হতে হয় বিভিন্ন হলের গণরুমে ওঠা প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের। মূলত যাঁরা ছাত্রলীগের ‘অবাধ্য’ হন, তাঁদের ওপরই গেস্টরুমে নেমে আসে নির্যাতন। এক যুগ ধরে নবীন শিক্ষার্থীদের গেস্টরুমে নির্যাতন করার অভিযোগ রয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ভাতৃপ্রতিম সংগঠন ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে।

গণরুম ও হলের কক্ষ নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এখন ছাত্রলীগ আছে সমান্তরাল প্রশাসনের ভূমিকায়। প্রথমে গণরুমে ও পরে ধীরে ধীরে শিক্ষার্থীদের অন্য কক্ষগুলোতে তোলে তারাই। গণরুমে রাখার বিনিময়ে নবীন শিক্ষার্থীদের ব্যবহার করে ছাত্রলীগ নিজেদের মিছিল লম্বা করে। তাদের আশ্রয়ে অনেক অছাত্র ও বহিরাগত হলগুলোতে থাকেন।

করোনা পরিস্থিতির কারণে দেড় বছর বন্ধ থাকার পর গত বছরের অক্টোবরে ক্যাম্পাস খোলার আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ হল থেকে অছাত্র বিতাড়ন এবং হলগুলোতে থাকা গণরুমের ব্যবস্থা বন্ধ করার ঘোষণা দিয়েছিল। কিন্তু এসব ঘোষণাতেই থেকে গেছে।

গত ২৬ জানুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজয় একাত্তর হলে প্রথম বর্ষের এক শিক্ষার্থীকে গেস্টরুমে ডেকে নেওয়া হয়। ছাত্রলীগের কর্মসূচি ও গেস্টরুমে না যাওয়ার অভিযোগ তুলে ওই শিক্ষার্থীকে বৈদ্যুতিক বাতির দিকে তাকিয়ে থাকতে বলা হয়। একপর্যায়ে তিনি অচেতন হয়ে পড়েন। নির্যাতনের শিকার আকতারুল ইসলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের প্রথম বর্ষের (২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষ) ছাত্র। এ ঘটনায় ২ ফেব্রুয়ারি ছাত্রলীগের তিন কর্মীকে বিজয় একাত্তর হল থেকে ছয় মাসের জন্য বহিষ্কার করেছে হল প্রশাসন।

গেস্টরুমে কী হয়

ছাত্রদের হলগুলোতে সাধারণত সন্ধ্যার পর বা রাতে অতিথিকক্ষে শিক্ষার্থীদের ডেকে নিয়ে ‘শিক্ষা’ দেওয়া হয়। এটিই গেস্টরুম সংস্কৃতি নামে পরিচিত। সপ্তাহে সাধারণত চার দিন হলভেদে ৪৫ মিনিট থেকে আড়াই ঘণ্টা পর্যন্ত এই কর্মসূচি চলে। দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীরা প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের গেস্টরুম করান। সেখানে হলের অতিথিকক্ষের সোফাগুলোতে বসেন দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীরা। প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের এ সময় সামনে থাকা চেয়ারে বসতে হয়। যেসব হলে চেয়ার নেই, সেখানে শিক্ষার্থীদের দাঁড়িয়ে থাকতে হয়।

গেস্টরুমে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার ১৬ জন শিক্ষার্থীর সঙ্গে গত তিন সপ্তাহে কথা বলেছে প্রথম আলো। তাঁরা বলেছেন, গেস্টরুমে প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের এক-এক করে সামনে ডেকে নানা প্রশ্ন করা হয়। উত্তর পছন্দ না হলে চলতে থাকে সমবেত গালিগালাজ। কখনো কখনো সামনে ডেকে রাজনৈতিক স্লোগানের ‘পরীক্ষা’ নেওয়া হয়। ‘ক্যাম্পাস চেনার জন্য’ প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের প্রায়ই রাত তিনটা-চারটা পর্যন্ত হলের বাইরে থাকতে বলা হয়। কখনো ক্যাম্পাসের বিভিন্ন প্রান্তে গিয়ে নিজের হল শাখা ছাত্রলীগের নামে মিছিল করতে বলা হয়। বড় ভাইদের ভয়ে শিক্ষার্থীরা গভীর রাতেও ক্যাম্পাসে ঘুরে ঘুরে হলের নামে স্লোগান দেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হলে থাকা সাধারণ শিক্ষার্থীদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ‘গেস্টরুম কর্মসূচি’তে দুটি পর্ব থাকে। প্রথম অংশে দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীরা প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের ‘ম্যানার’ শেখান এবং ‘অবাধ্যতা’ বা ‘অভিযোগের’ বিচারের নামে মানসিক নিপীড়ন করেন। কখনো কখনো শারীরিকভাবেও আঘাত করা হয় শিক্ষার্থীদের। এই পর্ব শেষ হলে অতিথিকক্ষে প্রবেশ করেন তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীরা। তাঁরা প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের হলে থাকার ‘উচ্চতর আচরণ’ শেখান। এরপর একে একে প্রবেশ করেন স্নাতক চতুর্থ বর্ষ এবং স্নাতকোত্তরের শিক্ষার্থীরা। এই পর্যায়ে হল শাখা ছাত্রলীগের জ্যেষ্ঠ নেতা-কর্মীরা সবার উদ্দেশে সাংগঠনিক নানা বিষয়ে কথা বলেন।

তবে এই কর্মসূচির আরও দুটি ধরন আছে। এগুলো হলো ‘মিনি গেস্টরুম’ ও ‘সিঙ্গেল মিনি গেস্টরুম’। প্রথম বর্ষের যেসব শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে ধারাবাহিকভাবে ‘অবাধ্যতার’ অভিযোগ আসতে থাকে, তাঁদের হলের অতিথিকক্ষের পরিবর্তে অন্য কোনো কক্ষে ডেকে নিয়ে মানসিক ও শারীরিক নিপীড়ন করেন দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীরা। এ ক্ষেত্রে কখনো কয়েকজন শিক্ষার্থীকে একসঙ্গে ডাকা হয়। এর নাম মিনি গেস্টরুম। কখনো আবার শুধু একজন শিক্ষার্থীকে ডাকা হয়। এর নাম সিঙ্গেল মিনি গেস্টরুম। মিনি গেস্টরুম ও সিঙ্গেল মিনি গেস্টরুমে শিক্ষার্থীদের বেশি নিপীড়ন করা হয়। এখানে মাঝেমধ্যে স্টাম্প-রড দিয়েও শিক্ষার্থীদের পেটানো হয় বলে অভিযোগ আছে।

মানসিক নিপীড়নের শিকার হওয়া মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হলের এক শিক্ষার্থী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার আগে এই বিশ্ববিদ্যালয়কে নিয়ে নিজের ভেতরে যেভাবে আবেগ কাজ করত, এখন আর সেটা করে না। যদি টাকা থাকত, তাহলে বাসা ভাড়া করে অন্য কোথাও থাকতাম।’

গণরুম-গেস্টরুমের নেপথ্যে

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তরের নিয়মিত শিক্ষার্থীরাই হলগুলোতে আসন বরাদ্দ পান। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়মিত শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৩৭ হাজার ১৮। এর মধ্যে ছাত্র ২০ হাজার ৭৭৩ জন, ছাত্রী ১২ হাজার ২৮ জন। ছাত্রদের জন্য ১৩টি হল ও ২টি হোস্টেলে আসন আছে ১১ হাজারের কিছু বেশি, ছাত্রীদের জন্য ৫টি আবাসিক হল ও ২টি হোস্টেলে রয়েছে ৫ হাজার ৭০০ জনের আবাসনব্যবস্থা। অর্থাৎ মোট শিক্ষার্থীর ৫৫ শতাংশেরই আবাসনব্যবস্থা নেই।

সক্ষমতা বিবেচনায় না নিয়ে গত দুই দশকে অপরিকল্পিতভাবে নতুন নতুন বিভাগ খুলে আসন বাড়িয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। ২০০০ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ২২ বছরে নতুন ৩৭টি বিভাগ ও ৩টি ইনস্টিটিউট হয়েছে। এই সময়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা সাড়ে ২২ হাজার থেকে বেড়ে ৩৭ হাজার হয়েছে। এর ফলে হলগুলোতে প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের বৈধ আসন পাওয়ার সুযোগ হচ্ছে না। দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে মেধার ভিত্তিতে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসা শিক্ষার্থীদের অনেকের থাকার অন্য জায়গা না থাকায় তাঁদের হলগুলোতে ছাত্রলীগ-নিয়ন্ত্রিত গণরুমেই উঠতে হয়।

গণরুম ব্যবস্থা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসনসংকটের ফলাফল। এই ব্যবস্থায় এক কক্ষে অনেক শিক্ষার্থীকে গাদাগাদি করে থাকতে হয়। কোনো কোনো গণরুমে এক কক্ষে ৪০-৫০ জন শিক্ষার্থীকে থাকতে হয়। গণরুমে থাকতে হলে শিক্ষার্থীদের নিয়মিত ছাত্রলীগের রাজনৈতিক কর্মসূচি ও গেস্টরুমে অংশ নিতে হয়। ছাত্রদের হলগুলোতে গণরুম-গেস্টরুমের প্রকোপ চরম হলেও ছাত্রী হলে এটি অনেকটাই কম। কারণ, সেখানে আসন বরাদ্দে প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ আছে।

বিভিন্ন হলের শিক্ষার্থীদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৮টি হলে ছাত্রলীগের নিয়ন্ত্রণে অন্তত ১৬০টি গণরুম আছে। শুধু গণরুম নয়, ছাত্রদের ১৩টি হলের প্রায় ৮০ শতাংশ কক্ষও ছাত্রলীগের বিভিন্ন পক্ষের নেতা-কর্মীদের নিয়ন্ত্রণে। আসন বরাদ্দে ছাত্রদের হলগুলোতে প্রশাসনের ভূমিকা সামান্য। যেমন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ হলের ২৯৬টি কক্ষের মধ্যে প্রায় সব কক্ষই ছাত্রলীগের নিয়ন্ত্রণে। স্যার এ এফ রহমান হলের ১০৪টি কক্ষের অন্তত ১০০টিই ছাত্রলীগের নিয়ন্ত্রণে। দুটি কক্ষ ‘সাংবাদিকদের কক্ষ’ হিসেবে পরিচিত। মাস্টারদা সূর্য সেন হলের ৩৮৮টি কক্ষের ৭০ শতাংশই ছাত্রলীগের নিয়ন্ত্রণে। এ ছাড়া হলটিতে চারটি কক্ষ ‘সাংবাদিকদের’, ২টি কক্ষ ‘তাবলিগের’ বলে পরিচিত। হাজী মুহম্মদ মুহসীন হলের ৩৮৮ কক্ষের বড় অংশই ছাত্রলীগের নিয়ন্ত্রণে। এই হলেও সাংবাদিকদের কক্ষ আছে। কিছু হলে ‘মন্ত্রিপাড়া’ নামে রাজনৈতিক ব্লকও আছে।

কক্ষ দখল ও নিয়ন্ত্রণের অভিযোগের বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘যেসব শিক্ষার্থীর থাকার বিকল্প ব্যবস্থা থাকে না, তাঁদের জন্য আমরা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে আহ্বান জানাই, দাবি করি এবং বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় তাদের সহযোগিতা নেওয়ার চেষ্টা করি৷ এটি আমরা কোনো রাজনৈতিক বা সাংগঠনিকভাবে সুবিধা নেওয়ার জন্য করি না৷ নবীন শিক্ষার্থীদের মাথা গোঁজার ঠাঁই করে দেওয়ার জন্য এটি করা হয়৷ তাঁর দাবি, হলের কক্ষ দখল বা নিয়ন্ত্রণ-এগুলো রাজনৈতিক টার্ম৷ যেকোনো ঘটনাকে রাজনৈতিক রঙ দেওয়ার জন্য এবং ছাত্রলীগকে ঘায়েল করার জন্য এগুলো ব্যবহার করা হয়।’

তবে হলে আসন বরাদ্দ ও সেই আসনে শিক্ষার্থীদের তুলে দেওয়ার ক্ষেত্রে প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণ না থাকার বিষয়টি স্বীকার করেছেন মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হলের প্রাধ্যক্ষ মোহাম্মদ বিল্লাল হোসেন। তিনি বলেন, সমস্যাটি অনেক দিন থেকে চলে আসছে। রাতারাতি এর সমাধান সম্ভব নয়।

গণরুম-গেস্টরুমকে কেন্দ্র করেই মূলত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের রাজনীতি আবর্তিত হয়। প্রতিটি হলে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক এবং বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের অনুসারী পক্ষ রয়েছে। সপ্তাহে চার-ছয় দিন প্রতিটি পক্ষ নিজেদের নিয়ন্ত্রিত কক্ষে থাকা শিক্ষার্থীদের গেস্টরুম করায়। গণরুমে রেখে প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের নিজেদের কর্মসূচিতে যেতে বাধ্য করে তারা। কেউ তাদের তৈরি এই নিয়মকানুনের অবাধ্য হলে বা কর্মসূচিতে অংশ না নিলে তাঁর ‘বিচার’ হয় গেস্টরুমে। অনেক সময় ‘শিবির কর্মী’ আখ্যা দিয়েও গেস্টরুমে শিক্ষার্থীদের নির্যাতন করা হয়।

অভিযোগের বিষয়ে ছাত্রলীগের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসেন বলেন, ‘প্রথম বর্ষের নবীন শিক্ষার্থীরা অনেক সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ ও বাস্তবতা বুঝে উঠতে পারেন না। কোনো সমস্যা-সংকটে পড়লে তাঁদের পাশে যেন আমরা থাকতে পারি, তা নিশ্চিতে আমরা তাঁদের নির্দেশনা দিই। অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটলে জড়িতদের বিরুদ্ধে আমরা সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিই।’

ছাত্রীদের হলগুলোতে কক্ষ বরাদ্দে ছাত্রলীগের নিয়ন্ত্রণ কম, ছাত্রত্ব শেষ হলে হল ছাড়তে হয়। ফলে নবীন শিক্ষার্থীদের অনেকে দ্রুতই আসন পেয়ে যান। তবে যাঁরা দ্রুত আসন পান না, তাঁরা ছাত্রলীগ-নিয়ন্ত্রিত কক্ষে ওঠেন। তাঁদের ছাত্রলীগের বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশ নিতে হয়।

দ্বিতীয় বর্ষে অধ্যয়নরত রোকেয়া হলের এক ছাত্রী প্রথম আলোকে বলেন, প্রশাসনিকভাবে হলে উঠলে নবীন শিক্ষার্থীদের তেমন সমস্যা হয় না। তবে এর জন্য কিছুদিন অপেক্ষা করতে হয়। যাঁরা একেবারে প্রথম দিন থেকেই ছাত্রলীগের হাত ধরে হলে ওঠেন, তাঁদের বাধ্যতামূলকভাবে কর্মসূচিতে অংশ নিতে হয়। ছাত্রলীগের নেত্রীদের কথামতো না চললে তাঁদের গেস্টরুমে ডেকে মানসিকভাবে নির্যাতন করা হয়।

বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের নির্বিকার ভূমিকার কারণে নবীন শিক্ষার্থীদের নির্যাতনের এই প্রক্রিয়া দশকের পর দশক ধরে চলে আসছে। বাম ধারার ছাত্রসংগঠনগুলো কখনো কখনো এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানালেও প্রশাসনের ভূমিকা দুর্বল হওয়ায় এই ব্যবস্থা চলে আসছে।

‘গেস্টরুম সংস্কৃতি’ বন্ধে সবার সহযোগিতা চেয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মো. আখতারুজ্জামান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, যেকোনো অভিযোগ হল প্রশাসনকে শিক্ষার্থীরা সরাসরি জানালে ভালো হয়।

গণরুমে পড়াশোনার পরিবেশ থাকে না। গাদাগাদি করে থাকা শিক্ষার্থীরা এক বিশৃঙ্খল জীবনের মধ্যে থাকেন। ছাত্রলীগের কর্মসূচি, গেস্টরুম, বড় ভাইদের নির্দেশে ঘুরতে বেরোনো—এসব মিলিয়ে অনেক শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবনে ধস নামে। উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত ভালো ফল করে আসা মেধাবী শিক্ষার্থীদের কেউ কেউ পড়াশোনায় চূড়ান্ত অমনোযোগী হয়ে পড়েন। এতে প্রথম সেমিস্টার থেকেই অনেকের ফল খারাপ হতে থাকে। এর ধারাবাহিকতা বিশ্ববিদ্যালয়জীবনজুড়ে চলতে থাকে।

বর্তমানে তৃতীয় বর্ষে অধ্যয়নরত বিজয় একাত্তর হলের এক ছাত্র প্রথম আলোকে বলেন, গণরুম-গেস্টরুমের কারণে শিক্ষার্থীদের মধ্যে পড়াশোনা-বিমুখতা তৈরি হয়। তাঁদের মধ্যে অর্থহীন আড্ডা দেওয়ার একটা প্রবণতা তৈরি হয়। এটা তাঁদের একাডেমিক জীবন নষ্ট করে দেয়।

শেষ কোথায়

ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠন পরিচালিত গেস্টরুম কর্মসূচি এবং এতে শিক্ষার্থী নির্যাতনের ঘটনাকে ‘মানবাধিকারবিরোধী’ কর্মকাণ্ড বলে মনে করেন ছাত্রদল, ছাত্র ইউনিয়ন ও ছাত্র অধিকার পরিষদের নেতারা। তাঁরা বলছেন, এই সংস্কৃতির অবসান হওয়া উচিত। তাঁদের দাবি, প্রশাসনকে মেরুদণ্ড নিয়ে দাঁড়াতে হবে।

হলগুলোতে গেস্টরুমে নির্যাতন বন্ধ ও মেধার ভিত্তিতে আসন বণ্টন নিশ্চিত করার দাবিতে গত ৩১ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের সামনে মানববন্ধন করেছে জাসদ ছাত্রলীগ। এর আগে ২৭ জানুয়ারি ক্যাম্পাসে মানববন্ধনে আইন করে গেস্টরুমে নির্যাতন বন্ধের দাবি জানায় ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থীদের একটি অংশ। এ ছাড়া জানুয়ারি মাসে পৃথক বিবৃতিতে গেস্টরুম নির্যাতন বন্ধের দাবি জানিয়েছে ছাত্রদল, সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট (বাসদ) ও ছাত্রলীগ-বিসিএল।

২৮ বছর পর ২০১৯ সালে ডাকসু নির্বাচন হলেও গণরুম-গেস্টরুমের বিরুদ্ধে ডাকসুর নেতাদের কোনো সম্মিলিত ভূমিকা দেখা যায়নি। তবে ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হক গণরুম-গেস্টরুমের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় বক্তব্য দিয়েছেন, উপাচার্যকেও এ বিষয়ে চিঠি দিয়েছেন। ডাকসুর সাবেক সদস্য তানভীর হাসান গণরুম ব্যবস্থা অপসারণে কিছুদিন আন্দোলন করেছেন এবং উপাচার্যকে স্মারকলিপি দিয়েছেন। কিন্তু পরিস্থিতির কোনো পরিবর্তন হয়নি।

শিক্ষার্থীদের নির্যাতন করার এই সংস্কৃতি দ্রুত বন্ধে প্রয়োজনে আইন করা উচিত বলে মনে করেন বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক নজরুল ইসলাম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, জ্যেষ্ঠ শিক্ষার্থী বা দলের অনুগত শিক্ষার্থীদের দিয়ে সাধারণ ছাত্রদের নির্যাতন বা হয়রানি করা অত্যন্ত নিন্দনীয় কাজ। এগুলো কোনো অবস্থাতেই সমর্থনযোগ্য নয়। তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া উচিত এবং সার্বিকভাবে উচ্চশিক্ষা কর্তৃপক্ষেরও বিষয়টি নিয়ে চিন্তিত হওয়া উচিত। এটি বন্ধ করার ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্বটাই মূল। তবে আরও উচ্চ মহলেও এ বিষয়ে চিন্তাভাবনা করা উচিত।-প্রথম আলো