পোস্তায় চামড়া আমদানি কম, বেড়েছে সংরক্ষণ খরচ

পোস্তায় চামড়া আমদানি কম, বেড়েছে সংরক্ষণ খরচ

পশুর চামড়া সংগ্রহের সবচেয়ে বড় মৌসুম ঈদুল আযহা। দেশে সারা বছর যে পরিমাণ পশু জবাই হয়, তার ৬০ শতাংশই হয় ঈদুল আযহায় কোরবানির মাধ্যমে।

রোববার (১০ জুলাই) ঈদের দিন রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার কোরবানির চামড়া দুপুর থেকে ব্যবসায়ীরা নিয়ে আসছেন পুরান ঢাকার লালবাগের পোস্তায়। সেখানে আড়তদাররা মৌসুমি ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চামড়া কিনছেন।
চামড়ার আমদানি কম হলেও গতবছরের তুলনায় দাম ১০০ টাকা বেড়েছে। অবশ্য দাম বাড়ার বিপরীতে চামড়া সংরক্ষণ খরচ ৭০ টাকা বেড়েছে বলে জানান ব্যবসায়ীরা।

লালবাগের পোস্তায় গিয়ে দেখা যায়, বিকেল ৩টার পর থেকেই ঢাকার বিভিন্ন স্থান থেকে কোরবানির চামড়া আসছে। আড়তদারদের হাঁকডাকে সরব হয়ে উঠেছে লালবাগের শায়েস্তা খান, রাজ নারায়ণ ধর রোডসহ আশপাশের বিভিন্ন রোড। পাইকারি ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন এলাকার মৌসুমি ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চামড়া সংগ্রহ শুরু করেছেন।

তবে পশু কোরবানি এখনো পুরোপুরি শেষ না হওয়ায় পোস্তায় এখনো পুরোদমে শুরু হয়নি কাঁচা চামড়ার বেচা-কেনা। রাতের দিকে পুরোদমে চামড়া কেনাবেচা শুরু হবে। চামড়া কেনা চলবে আগামী এক মাস।

আজ বড় আকারের প্রতিটি চামড়া ৮৫০ থেকে এক হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে এবং ছোট ও মাঝারি আকারের চামড়াগুলো ৩০০ টাকা থেকে ৬০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে৷ এছাড়া গড়ে ৬৫০ থেকে ৭০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে।

পোস্তার ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলা জানা যায়, চামড়া সংগ্রহের প্রস্তুতি নেওয়া হলেও বিকেল ৫টার পর থেকে চামড়া কেনাবেচা জমে ওঠে। গভীর রাত পর্যন্ত চামড়া সংগ্রহ করা হবে। এখানে চামড়া সংগ্রহের পর প্রথমে লবণজাত করা হবে। পরে তারা সাভারের ট্যানারিগুলোতে পাঠিয়ে দেবেন। এবছর চামড়ার দাম ভালো৷ গড়ে প্রতিটি চামড়া ৬৫০ থেকে ৭০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। যা গতবছর ৫০০ থেকে ৬০০ টাকায় বিক্রি হয়েছিলো। এছাড়া দেশের সবচেয়ে বড় কাঁচা চামড়ার আড়তে গতবারের মতো এবারো লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী চামড়া সংগ্রহ হবে না বলে আশঙ্কা ব্যবসায়ীদের।

এ বিষয়ে ছমির হানিফ এন্ড সন্সের মালিক হাজী মো. ছমির উদ্দিন বাংলানিউজকে বলেন, ৪৬ বছর ধরে চামড়ার ব্যবসা করছি। এখন পোস্তায় আগের মতো আর চামড়া আসে না। অনেক চামড়া সরাসরি ট্যানারিতে চলে যায়। তাই মনে হচ্ছে আমদানি কম। আগে হাজার হাজার ফড়িয়া আসতো এখন আর তারা আসে না। কারণ ফড়িয়াদের হাতে পর্যাপ্ত টাকা নেই এবং তারা সরাসরি ট্যানারি মালিকের কাছে বিক্রি করে দেয়। এবছর প্রতিটি চামড়ার দাম ৮০ থেকে ১০০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। একই সঙ্গে লবণ ও শ্রমিকের দাম বাড়ায় চামড়া সংরক্ষণ খরচ বেড়েছে ৭০ টাকা। ট্যানারি মালিকরা যদি সরকার নির্ধারিত দাম দেয় তাহলে আড়তদাররা লোকসানের হাত থেকে বেঁচে যাবে।

পোস্তার এস এম কামাল এন্ড সন্সের মালিক হাজী মো. কামাল বাংলানিউজকে বলেন, আমরা সরকার নির্ধারিত দামেই লবণযুক্ত চামড়া কিনছি। গত বছরের তুলনায় এবছর চামড়ার দাম ভালো যাচ্ছে। তবে লবণ ছাড়া চামড়ার দাম ফুটে ৫/৭টাকা কমে কিনছি। এ বছর আড়তে চামড়ার আমদানি কম।

তিনি অভিযোগ করে বলেন, কিছু মৌসুমি ব্যবসায়ী বাজার নষ্ট করছে এবং ট্যানারি মালিকরা সরাসরি চামড়া কিনছেন। আমরা চামড়া কেনার জন্যই বসে আছি। চামড়া নিয়ে আসলে কেউ ফেরত যাবে না। সবাই ন্যায্য দাম পাবে। তবে অবশ্যই চামড়া গুনগতমান ঠিক থাকতে হবে।

নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ থেকে চামড়া নিয়ে এসেছেন আব্দুল বাতেন। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, ৪৮টি চামড়া নিয়ে এসেছি। গড়ে ৬৫০ টাকা বিক্রি করছি। গত বছর গড়ে ৫০০ থেকে ৫৫০ টাকায় বিক্রি করেছি। এ বছর চামড়ার আমদানি কম হওয়ায় দাম ভালো যাচ্ছে।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ হাইড অ্যান্ড স্কিন মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের (বিএইচএসএমএ) সাধারণ সম্পাদক টিপু সুলতান বাংলানিউজকে বলেন, ঢাকা শহর ও এর আশেপাশের কোরবানির পশুর চামড়া পোস্তায় আসতে শুরু করেছে। এবছর চামড়ার আমদানি কম৷ মৌসুমি ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে সরাসরি চামড়া কিনছে ট্যানারি মালিকরা। এছাড়া এবছর মৌসুমী ব্যবসায়ীদের আনাগোনা কম। তবে মাদ্রাসা ভিত্তিক ব্যবসায়ীদের বেশি দেখা যাচ্ছে।

তিনি বলেন, গত কয়েক বছর চামড়ার লোকসান দিয়ে কিছু মৌসুমি ব্যবসায়ী এ পেশা ছেড়ে দিয়েছে। অর্থ সংকটে অনেক ব্যবসায়ী চামড়া কিনছেন না।

তিনি আরও বলেন, এ বছর আমরা গরুর চামড়া ৫৫ লাখ আর মহিষ, ছাগল ও ভেড়ার চামড়া ২৭ লাখ সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছি। আশা করছি লক্ষ্যমাত্রার কাছাকাছি সংগ্রহ করতে পারবো। তবে ঈদের তিন দিন সাড়ে ৩ লাখ কাঁচা চামড়া সংগ্রহ করতে পারবো। পাশাপাশি লবণযুক্ত চামড়া ২৭ লাখ; সব মিলিয়ে পোস্তায় ৩০ থেকে ৩১ লাখ পিস চামড়া সংগ্রহ করা হবে৷ এ বছর চামড়ার দাম গত বছরের তুলনায় বেড়েছে। পাশাপাশি লবণের দাম বস্তায় ৩৫০ টাকা ও শ্রমিক মূল্যও বড়েছে। ফলে আমাদের সংরক্ষণ খরচও বেড়েছে।

প্রতি বছরের মতো সরকার লবণযুক্ত চামড়ার মূল্য নির্ধারণ করে দিয়েছে। এবার ঢাকায় লবণযুক্ত প্রতি বর্গফুট গরুর চামড়ার মূল্য ৪৭ থেকে ৫২ এবং সারা দেশে ৪০ থেকে ৪৪ টাকা নির্ধারণ করেছে সরকার। এছাড়া খাসির চামড়া ১৮ থেকে ২০ টাকা এবং বকরির চামড়া ১২ থেকে ১৪ টাকা বর্গফুট নির্ধারিত আছে। গতবছর ঢাকায় লবণযুক্ত গরুর চামড়ার দাম প্রতি বর্গফুট ৪০ থেকে ৪৫ টাকা। ঢাকার বাইরে ৩৩ থেকে ৩৭ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। এ ছাড়া সারা দেশে খাসির চামড়া ১৫ থেকে ১৭ টাকা। বকরির চামড়ার দাম নির্ধরণ করা হয়েছে ১২ থেকে ১৪ টাকা।

গরুর আকৃতি ও ওজনভেদে চামড়ার পরিমাণ কমবেশি হয়। সাধারণত গরুর চামড়া সর্বনিম্ন ২২ থেকে সর্বোচ্চ ২৬ বর্গফুট পর্যন্ত হয়। আর ছাগল-খাসির চামড়ার গড়হার হচ্ছে সাড়ে ৪ বর্গফুট। এ বছর কোরবানি থেকে চামড়া আড়তদার ও ট্যানারি মালিকরা প্রায় ৯০ লাখ পিস চামড়া সংগ্রহের আশা করছেন।

প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের তথ্যানুসারে, এ বছর গরু, ছাগল, ভেড়া ও উট মিলিয়ে ১ কোটি ২১ লাখ ২৪ হাজার ৩৮৯টি পশু কোরবানির জন্য প্রস্তুত করা হয়েছিল। গত বছর কোরবানিযোগ্য পশুর সংখ্যা ছিল ১ কোটি ১৯ লাখ ১৬ হাজার ৭৬৫টি। এর মধ্যে কোরবানি হয় ৯০ লাখ ৯৩ হাজার ২৪২টি পশুর।

ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের তথ্যানুযায়ী, বছরে বাংলাদেশে প্রায় ২২ কোটি বর্গফুট চামড়া পাওয়া যায়। এর মধ্যে ৬৪ দশমিক ৮৩ শতাংশ গরুর চামড়া, ৩১ দশমিক ৮২ শতাংশ ছাগলের, ২ দশমিক ২৫ শতাংশ মহিষের এবং ১ দশমিক ২ শতাংশ ভেড়ার চামড়া।