মিয়ানমার থেকে চোরাই পথে বিস্ফোরক দ্রব্য আনছে আরসা, নিরাপত্তায় বড় হুমকি

মিয়ানমার থেকে চোরাই পথে বিস্ফোরক দ্রব্য আনছে আরসা, নিরাপত্তায় বড় হুমকি

অস্ত্র, গোলাবারুদ ও মাদকের পর এবার মিয়ানমার থেকে বিস্ফোরক নিয়ে আসছে শীর্ষ সন্ত্রাসী গোষ্ঠী আরাকান রোহিঙ্গা সলভেশন আর্মি (আরসা)।

চোরাই পথে সীমান্ত অতিক্রম করে বিস্ফোরক দ্রব্যগুলো উখিয়া টেকনাফের রোহিঙ্গা ক্যাম্প ও আশপাশের গহীন বনে কারখানা গড়ে তুলে বোমা, মাইনসহ নাশকতায় ব্যবহৃত নানা ধরনের ক্ষতিকারক জিনিস তৈরি করছে। ফলে ক্যাম্প ঘিরে নিরাপত্তায় বড় হুমকি দেখা দিয়েছে।

গেল মঙ্গলবার রাতে উখিয়ার তেলখোলা-বরতলী এলাকায় অভিযান চালিয়ে আরসার বোমা তৈরির কারিগর গান কমান্ডার রহিমুল্লাহ ওরফে মুছাকে আটক করেছে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন-র‌্যাব। এ সময় তার সহযোগী ও আরসার আরেক শীর্ষ সন্ত্রাসী সামছুল আলম ওরফে মাস্টার সামছু এবং বাংলাদেশি শফিক ও সিরাজকে আটক করা হয়। অভিযানে তাদের কাছ থেকে ৪৪ কেজি বিস্ফোরক দ্রব্য ও দেশ-বিদেশি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করা হয়।

এ বিষয়ে বুধবার দুপুরে র‌্যাব-১৫ এর কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক খন্দকার আল মইন।

তিনি জানান, বিস্ফোরক দ্রব্যে ক্লোরেটস, ব্রোমেটস, পটাশিয়াম ও হেক্সামিথাইলিন টেট্রামাইন জাতীয় রাসায়নিক উপাদানের উপস্থিতি পাওয়া গেছে যা গান পাউডার বা উচ্চ বিস্ফোরক হিসেবে ব্যবহার হতে দেখা যায়।

তিনি আরও জানান, উপাদানগুলো বিস্ফোরণের সময় সহায়ক হিসেবে অল্প সময়ে বড় ধরণের অগ্নিকাণ্ড সংঘটিত করতে সক্ষম। বিস্ফোরক দ্রব্যের মাধ্যমে বোমা প্রস্তুত করে আধিপত্য বিস্তারের জন্য শরণার্থী শিবিরে হামলা, অগ্নিসংযোগের উদ্দেশ্যে ব্যবহার করতো বলে প্রাথমিক স্বীকারোক্তি দিয়েছে আরসার গান কমান্ডার মুছা।

 

খন্দকার আল মইন জানান, বিস্ফোরক ব্যবহার করে ক্যাম্পে বিভিন্ন সময় অগ্নিকাণ্ডের মতো নাশকতা করেছে আরসা। তাছাড়া ক্যাম্পের ভেতর বাইরে বোমা তৈরির কারখানাও আছে। এত বিপুল সংখ্যক বিস্ফোরক দ্রব্য যেহেতু পাওয়া গেছে তাই ক্যাম্পে বা ক্যাম্পের বাইরে বড় কোনো নাশকতার পরিকল্পনা ছিল কিনা তা খতিয়ে দেখছে র‌্যাব।

নির্বাচনকে কেন্দ্র করে কোনো স্বার্থান্বেষী মহল আরসা কিংবা অন্যান্য সন্ত্রাসীদের ব্যবহার করে নাশকতার পরিকল্পনা করছে কি না জানতে চাইলে র‌্যাবের এই পরিচালক জানান, বিষয়টি উড়িয়ে দেয়ার মতো নয়। এই ধরণের পরিকল্পনা থাকতেও পারে। কারণ এত বিপুল বিস্ফোরক দ্রব্য তারা কেন মজুত করলো?

র‌্যাব বলছে, মিয়ানমারের সীমান্ত পর্যন্ত একটি গ্রুপ এই বিস্ফোরক দ্রব্যগুলো পৌঁছে দেয়। এরপর বাংলাদেশি নাগরিক শফিক ও সিরাজের মতো কিছু সদস্য সেগুলো কৌশলে ক্যাম্পে মুছার কাছে পৌঁছে দেয়। মুছার কারখানায় আরসার অন্যান্য সদস্যদের সেগুলো দিয়ে বোমা তৈরির প্রশিক্ষণ দেয়।

গান কমান্ডার কে এই মুছা?

র‌্যাব ও রোহিঙ্গা সূত্রে জানা গেছে, খুন, চাঁদাবাজি, নির্যাতনসহ নানা অপরাধ নিয়ন্ত্রণের জন্য ১৮ নাম্বার ক্যাম্পে আরসার প্রধান জিম্মাদার হলেও অস্ত্র চালানো, বোমা তৈরির প্রশিক্ষণসহ সামরিক শাখার সকল দায়িত্ব ছিল মুছার। ফলে ধীরে ধীরে আরসার কাছে গান কমান্ডার হিসেবে পরিচিত পায় মুছা।

তথ্য বলছে, রহিমুল্লাহ ওরফে মুছা (২৭) জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত মিয়ানমারের নাগরিক। তিনি ২০১৭ সালে অবৈধভাবে বাংলাদেশে প্রবেশ করে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অবস্থান করে। বাংলাদেশে আসার পর মুছা মিয়ানমারে থাকা তার আত্মীয় স্বজনদের মাধ্যমে বিভিন্ন কৌশলে বাংলাদেশে ইয়াবার চালান নিয়ে এসে নিজে এবং তার সহযোগীদের মাধ্যমে বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে পৌঁছে দিতেন। পরে ২০১৮ সালে আরসা নেতা খালেদের মাধ্যমে ‘আরসায়’ আনুষ্ঠানিকভাবে যোগ দেন মুছা।

আরসার সন্ত্রাসী গ্রুপের বিভিন্ন কার্যক্রমে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে অস্ত্র, গোলাবারুদ সরবরাহ, অপহরণ, খুন, ক্যাম্পের আধিপত্য নিজ কুক্ষিগত করার লক্ষ্যে ক্যাম্পে গোলাগুলিসহ সন্ত্রাসী কার্যক্রম পরিচালনা করেন। আরসা’র নেতা হাফেজ সাইফুল ইসলামের সঙ্গে তার বিশেষ সখ্যতা রয়েছে।

এ ছাড়াও আবু আনাস, মোহাম্মদ হাসান, খালেদসহ কিছু আরসা’র শীর্ষ নেতার সঙ্গে তার পরিচয় ও সরাসরি যোগাযোগ ছিল। মিয়ানমার ও বাংলাদেশের দুর্গম সীমান্তবর্তী এলাকায় অস্ত্র ও বোমা বিষয়ক প্রশিক্ষণগ্রহণ করেন মুছা।

মুছা বোমা তৈরিতে ও অস্ত্র চালনায় বিশেষ পারদর্শী হওয়ায় আরসার গান কমান্ডার ও ক্যাম্প-১৮ এর জিম্মাদার হিসেবে দায়িত্ব পায়।

তিনি আরসা’র অন্যান্য সদস্যদের বোমা তৈরি ও অস্ত্র চালনার প্রশিক্ষণ দিতেন। তার নেতৃত্বেই বালুখালী শরণার্থী ক্যাম্পের আরসার সদস্যরা খুন, টার্গেট কিলিং, অপহরণ, ডাকাতি, চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন ধরণের অপরাধ কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে।

তিনি হেড মাঝি আজিম উদ্দিন হত্যাকাণ্ড, সাবমাঝি জাফর হত্যাকাণ্ড, এপিবিএন পুলিশের উপর হামলা, মাদরাসায় হামলা করে নৃশংসভাবে ৬ জন শিক্ষক ও ছাত্রকে হত্যা, জসিম হত্যাকাণ্ড, হেডমাঝি শফিক হত্যাকাণ্ড, মৌলভী সামশুল আলম হত্যাকাণ্ড, নুর হাসিম ও নূর হাবা হত্যাকাণ্ড ও সাবমাঝি আইয়ুব হত্যাকাণ্ডসহ বিভিন্ন হত্যাকাণ্ডে জড়িত ছিলেন।

এ ছাড়াও ২০২২ সালের নভেম্বরে গোয়েন্দা সংস্থা ও র‌্যাবের মাদকবিরোধী যৌথ অভিযানের সময় সন্ত্রাসীদের হামলায় গোয়েন্দা সংস্থার একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নিহত হন এবং একজন র‌্যাব সদস্য গুরুতর আহত হন। ওই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে মুছা জড়িত ছিলেন বলে জানা যায়। বিভিন্ন সময়ে অপহরণ অথবা টার্গেট কিলিং শেষে কক্সবাজারের গহীন পার্বত্য এলাকা ও চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় আত্মগোপনে থাকতেন তিনি।

তার বিরুদ্ধে উখিয়া, নাইক্ষ্যংছড়িসহ বিভিন্ন থানায় হত্যা, অপহরণ, অস্ত্রসহ বিভিন্ন অপরাধে ১২টির অধিক মামলা রয়েছে এবং বিভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন মেয়াদে কারাভোগ করেছে বলে জানা যায়।

আরসার ক্যাম্প জিম্মাদার মাস্টার সামছু

সামছু ২০১২ সালের শেষে দিকে অবৈধভাবে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করে ক্যাম্পে অবস্থান করেন। তিনি ২০১৩ সালে ভুয়া পাসপোর্ট তৈরি করে মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশে যান এবং ২০১৮ সালে পুনরায় বাংলাদেশে ফেরত এসে রোহিঙ্গা শরণার্থী হিসেবে অবস্থান করতে থাকে।

তিনি ২০১৯ সালে মৌলভী জাবেদের মাধ্যমে সন্ত্রাসবাদী সংগঠন আরসা’য় যোগ দেন। আরসা’য় যোগদানের পর তিনি অস্ত্র চালনা ও রণকৌশল সম্পর্কে প্রশিক্ষণ লাভ করে। পরবর্তীতে ক্যাম্প-৪ এর অন্যতম কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পান।

তিনি বিভিন্ন সময়ে আরসা’র শীর্ষ নেতাদের নির্দেশনায় টার্গেট কিলিং, অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায় এবং মুক্তিপণ না পেলে হত্যাপূর্বক লাশ গুম করতো বলে জানা যায়।

মুছার উদ্বৃতি দিয়ে র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক খন্দকার আল মইন জানান, আরসা প্রধান আতাউল্লাহ আবু আম্মার জুনুনী বাংলাদেশের ভূখণ্ডে নেই। বিদেশে বসে বাংলাদেশের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সকল অপরাধের কলকাঠি নাড়ছে। ক্যাম্পে বা ক্যাম্পের বাইরে যেসব আরসা নেতা সক্রিয় রয়েছে চলমান অভিযানে তারাও ধরা পড়বে।