‘ওরা আমার ছেলেকে গুলি করে মেরে ফেলল’

‘ওরা আমার ছেলেকে গুলি করে মেরে ফেলল’

‘আমার চার ছেলে, এক মেয়ের মধ্যে শাওন সবার বড়। ছেলেটা অল্প বয়সে বিয়ে করল, আমাদের সংসারের হাল ধরল। গত বুধবার বাড়ি থেকে যাওয়ার আগে আমাকে বলেছিল, ঘুরতে যাচ্ছে, তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে আসবে। কিন্তু আমার ছেলে আর ফিরে এল না। ওরা আমার ছেলেকে গুলি করে মেরে ফেলল। আমার আট মাস বয়সী নাতিটাও বাবাকে চেনার আগে হারিয়ে ফেলল।’

কথাগুলো বলছিলেন লিপি আক্তার। তিনি মুন্সিগঞ্জ সদর উপজেলায় পুলিশের গুলিতে নিহত যুবদল কর্মী শাওন ভূঁইয়ার (২২) মা।

আজ শুক্রবার সকালে উপজেলার মিরকাদিম পৌরসভার মুরমা এলাকায় শাওনদের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, সন্তান হারিয়ে দিশাহারা হয়ে ঘরের এক কোণে বসে কাঁদছেন মা লিপি আক্তার। বাড়িতে দুটি ভাঙা টিনের ঘর। আরেকটির ভেতর বসে কাঁদছিলেন শাওনের স্ত্রী সাদিয়া আক্তার। এ বাড়ির ছেলে শাওন পেশায় ছিলেন ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার চালক। পাশাপাশি মিরকাদিম পৌরসভা ৮ নম্বর ওয়ার্ড যুবদলের কর্মী হিসেবে দলের বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশ নিতেন তিনি।

ওই বাড়ির বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২০২১ সালে শাওনের সঙ্গে সাদিয়ার বিয়ে হয়। আট মাস আগে তাঁদের একটি ছেলেসন্তানের জন্ম হয়। শিশুটির নাম রাখা হয় সাহাদ ভূঁইয়া। অভাব-অনটনের সংসারে যখন যে কাজ পেতেন, তা-ই করতেন শাওন। সে উপার্জন দিয়েই স্ত্রী-সন্তান ও মা–বাবার খরচ জোগাতেন।

সাদিয়া আক্তার বলেন, ‘বিয়ের পর শ্বশুরবাড়ি ও বাবার বাড়ি দুই জায়গায়ই থাকতাম। ছেলে হওয়ার পর থেকে বাবার বাড়িতে ছিলাম। গত সোমবার শাওন আমাদের বাড়িতে গিয়েছিল। সেদিন আসার সময় আমাকে বলেছিল, দু-এক দিন পরে আমাকে তাঁর বাড়িতে নিয়ে যাবে। এ জন্য সে বাজার-সদাই করবে। তাই এ কয়েক দিন সে খুব মনোযোগ দিয়ে কাজ করবে।’ কথা বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন সাদিয়া। এরপর আবার বলেন, ‘শাওন আমাকে ও ছেলেকে বাড়ি নিয়ে এল না। আমরা নিজেরাই এলাম। শাওন তো আর এল না। আমি শাওন হত্যার বিচার চাই।’

শাওনের ছোট ভাই সোহান ভূঁইয়া জানান, শাওন বাবার সঙ্গে রিকশা চালিয়ে সংসার চালাতেন। বুধবার বিএনপির সমাবেশে গিয়েছেন তিনি। সেখানে পুলিশ তাঁকে লক্ষ্য করে মাথায় গুলি করে। এতে তাঁর ভাই তখনই জ্ঞান হারান। বুধবার সন্ধ্যা সাতটার দিকে শাওনকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আনা হয়। এর পর থেকে তাঁর ভাই লাইফ সাপোর্টে ছিলেন। গতকাল বৃহস্পতিবার রাত নয়টার দিকে তাঁর মৃত্যু হয়।

জ্বালানি তেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধি ও দলীয় নেতা-কর্মী হত্যার প্রতিবাদে মুন্সিগঞ্জ শহরের অদূরে মুক্তারপুরে বুধবার বেলা তিনটার দিকে বিক্ষোভ কর্মসূচির আয়োজন করে জেলা বিএনপি। সেখানে বিএনপির নেতা-কর্মীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ হয়। সংঘর্ষের মধ্যে গুলিতে শাওন ভূঁইয়া ও বিএনপির সমর্থক জাহাঙ্গীর মাদবর (৩৮) গুরুতর আহত হন।

বুধবারের ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী, পুলিশ ও দলীয় নেতা-কর্মীরা জানান, বেলা তিনটার দিকে পূর্বনির্ধারিত সমাবেশে যোগ দিতে বিভিন্ন উপজেলা থেকে আসা বিএনপির নেতা-কর্মীরা মুক্তারপুর মোড়ে জড়ো হতে থাকেন। পুলিশ তাঁদের সেখানে জড়ো হতে নিষেধ করলে তাঁরা মুক্তারপুর থেকে ট্রাকে পুরোনো ফেরিঘাট এলাকায় যান। সেখানে বিভিন্ন এলাকা থেকে ছোট ছোট মিছিল নিয়ে নেতা-কর্মীরা আসতে শুরু করেন। তখন সদর সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মিনহাজুল ইসলাম একটি মিছিলের ব্যানার ধরে টান দিলে সংঘর্ষের সূত্রপাত হয়। ওই ঘটনায় পুলিশ, সাংবাদিকসহ উভয় পক্ষের অন্তত ৭০ জন আহত হন। আহত ব্যক্তিদের মধ্যে বিএনপির নেতা-কর্মী ৫০ থেকে ৬০ জন, ৩ জন সংবাদকর্মী এবং ১৫ থেকে ২০ জন পুলিশ সদস্য রয়েছেন।