‘সাকিব-তামিম ইস্যু ক্রিকেট বোর্ড সামলাতে ব্যর্থ’

‘সাকিব-তামিম ইস্যু ক্রিকেট বোর্ড সামলাতে ব্যর্থ’

তামিম-সাকিব ইস্যুতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক লাইভে ক্রিকেট বোর্ডের প্রতি নিজের ক্ষোভ জানিয়ে জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক খালেদ মাসুদ পাইলট বলেছেন, ‘আমরা ডিম সিন্ডিকেট, ডাব সিন্ডিকেট শুনি, আমার কাছে মনে হয় ক্রিকেটের সিন্ডিকেট তৈরি হয়েছে। বিগত বেশ কয়েক বছর ধরে এটা চলছে, এভাবে চললে ক্রিকেটটা ধ্বংসের পথে যাবে।’

বুধবার বিশ্বকাপ খেলতে ভারতে পৌঁছেছে বাংলাদেশ ক্রিকেট দল। বৃহস্পতিবার সেখানে প্রথম অনুশীলনের পর, শুক্রবার প্রস্তুতি ম্যাচ মাঠে নামবে বাংলাদেশ। কিন্তু এসব নিয়ে আলোচনা-আগ্রহ কোনোটাই নেই ক্রিকেটপ্রেমীদের।

বরং এক দিন আগে বিশ্বকাপের দল ঘোষণা ও সেখানে তামিম ইকবালের না থাকাটাই জন্ম দেয় নানা বিতর্কের।

এরপর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিজের অবস্থান ব্যাখ্যা করেন তামিম ইকবাল। আর রাতে এক সাক্ষাৎকারে তামিম ও নিজের প্রসঙ্গে নানা প্রশ্নের উত্তর দেন সাকিব আল হাসান।

তামিম তার ভিডিওতে সরাসরি সাকিবের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ করেননি। তবে সাকিব আল হাসান তার সাক্ষাৎকারে তামিম ইকবাল প্রসঙ্গে বেশ কয়েককটি মন্তব্য করেছেন।

যদিও তিনি দাবি করেছেন, তামিমের বাদ পড়ার বিষয়ে তার কোনো ভূমিকা ছিলে না।

ক্রিকেটের বাইরে এসব বিতর্কই এখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে চায়ের টেবিল সবখানে। যা স্পষ্টতই দুটি ভাগ গড়ে দিয়েছে সমর্থকদের মধ্যে।

ক্রিকেট প্রশিক্ষক নাজমুল আবেদীন ফাহিম বলেন, ‘আমরা সোশ্যালি এত ডিভাইড হয়ে যাই সহজে, এই ঘটনা আমাদের আরো ডিভাইড করে দিতে পারে। সামনে বিশ্বকাপ খেলতে যাচ্ছি, এ সময় এই বিভক্তি আমাদের ফোকাসটা অন্যদিকে নিচ্ছে, যা বিশ্বকাপে নেতিবাচক ভূমিকা রাখবে।’

বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের সঙ্গে দীর্ঘদিন কাজ করা নাজমুল আবেদীন ফাহিমও মনে করেন বিসিবি এই ঘটনা ঠিকভাবে সামলাতে পারেনি, ফলে সবকিছু নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে।

সাকিব-তামিম ইস্যু যেভাবে সামনে এলো
বিশ্বকাপে দল ঘোষণার আগে সবচেয়ে আলোচিত প্রশ্ন ছিল দুটি- তামিম ইকবাল কি থাকছেন, আর মাহমুদুল্লাহ রিয়াদকে কি দলে নেয়া হবে?

কিন্তু দল ঘোষণার পর সব আলোচনা ঘুরে যায় এক নম্বর প্রশ্ন ঘিরেই। তামিম ইকবালকে ছাড়াই ১৫ জনের বিশ্বকাপ স্কোয়াড ঘোষণা করে নির্বাচকরা। দল ঘোষণার সংবাদ সম্মেলনেও বেশিরভাগ প্রশ্ন ছিল এটা নিয়েই, তামিমকে কেন বাদ দেয়া হলো?

নির্বাচকেরা এর ব্যাখ্যা হিসেবে বলেন ফিটনেস ঘাটতি থাকার কারণেই তামিমকে দলে রাখা হয়নি। কিন্তু এ নিয়ে বিতর্ক শুরু হয় অবশ্য দল ঘোষণার আগে থেকেই।

কয়েকটা গণমাধ্যমে খবর আসে, তামিম বিশ্বকাপে পাঁচটা ম্যাচ খেলতে চেয়েছেন, আর সেটাই বড় কারণ তাকে বাদ দেয়ার। আবার এমনও বলা হয়, বিশ্বকাপে তার ব্যাটিং অর্ডার পরিবর্তন করতে চেয়েছে বোর্ড, যা তামিম মেনে নেননি, আর এ কারণেই বাদ পড়তে হয় তাকে।

আর এ সবগুলো ঘটনার পেছনে অধিনায়ক সাকিব আল হাসানকে দায়ী করে একটা পক্ষ। তাদের দাবি, পুরোপুরি ফিট নয় এমন কোনো ক্রিকেটারকে অধিনায়ক সাকিব দলে চাননি বলেই তামিম ইকবালের জায়গা হলো না বিশ্বকাপে। বিভিন্ন গণমাধ্যম থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এ নিয়ে শুরু হয় তুমুল বিতর্ক।

আর এভাবেই গণমাধ্যম এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের আলোচনায় এক সময়ের ঘনিষ্ঠ বন্ধু তামিম ইকবাল আর সাকিব আল হাসান চলে আসেন মুখোমুখি অবস্থানে।

তবে এর পেছনে কোনো তৃতীয় পক্ষও কাজ করে থাকতে পারে বলে শঙ্কা সাকিব-তামিমের এক সময়ের কোচ নাজমুল আবেদীনের।

তিনি বলেন, ‘আমি খুব সম্প্রতি শুনেছি যে তারা কেউ কথা বলে না, আমি খুবই অবাক হয়েছি। কারণ তারা এত ক্লোজ ছিল যে পরিবারের চেয়ে বেশি সময় নিজেদের সাথে কাটিয়েছে। এটা নিশ্চয় মিনিমাইজ করা যেত, কেন করা গেল না, আশপাশে যারা থাকে তারা দূরত্বটা বাড়িয়ে দিল কি-না, কারণ অনেকে ডিভাইড অ্যান্ড রুল পছন্দ করে।’

বিকেএসপির এই শিক্ষক মনে করেন, সাকিব-তামিমের ভাগাভাগি হয়ে যাওয়া মানে বাংলাদেশ ক্রিকেটের ভাগাভাগি, যা কাঙ্ক্ষিত নয়।

সাকিব আল হাসানের সাক্ষাৎকার যে কারণে আলোচনায়
বুধবার রাত ১১টায় বাংলাদেশের খেলার চ্যানেল টি-স্পোর্টস সাকিব আল হাসানের সাথে প্রায় আধা ঘণ্টার এক সাক্ষাৎকার প্রচার করে। সেখানে তামিম ইকবাল ও তার নিজের বিষয়ে নানা মন্তব্য করেন সাকিব।

প্রথমত তিনি তামিম ইকবালের বাদ পড়া প্রসঙ্গে নিজের কোনো ভূমিকার কথা অস্বীকার করেন।

তিনি বলেন, ‘আমার তো দায়িত্ব না পুরো দল নির্বাচন করা, এটা অনেক প্রসেসের ভেতর দিয়ে যেতে হয়। মাঠ ও মাঠের বাইরে অনেক কিছু বিবেচনায় থাকে। আর আমি এগুলোতে এখন খুবই কম যুক্ত থাকি।’

তামিমের ব্যাটিং অর্ডার পরিবর্তন প্রসঙ্গেও তার সাথে কোনো আলোচনা হয়নি বলে দাবি করেন সাকিব আল হাসান। কিন্তু তার মতে, দলের প্রয়োজনে যে কারো যেকোনো পজিশনে ব্যাট করা উচিত।

তিনি বলেন, ‘এটাতে খারাপ কিছু আছে বলে আমি মনে করি না। এটা আমার কাছে মনে হয় একেবারে বাচ্চা মানুষের মতো যে আমার ব্যাট আমি খেলব, আর কেউ খেলতে পারবে না। টিমের জন্য যে কেউ যেকোনো জায়গায় খেলতে রাজি থাকা উচিত।’

এ প্রসঙ্গে সাকিব বলেন, দল সবসময় আগে, এখানে ব্যক্তিগত অর্জনের কোনো মানে নেই।

তামিম ইকবালের ফিটনেস প্রসঙ্গেও প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন অধিনায়ক সাকিব। তিনি কি আসলেই পাঁচটা ম্যাচ খেলতে চেয়েছিলেন, আর এ কারণেই কি তিনি তামিমকে দলে নেননি?

সাকিব বলেন, ‘এটা পুরাটা ভুল, এই বিষয় নিয়ে কারো সাথে আমার কোনো আলোচনাই হয়নি।’

কিন্তু এরপরই সাকিব আল হাসান ভারতীয় ক্রিকেটার মহেন্দ্র সিং ধোনির একটা উক্তি টেনে বলেন, ‘কোনো খেলোয়াড় যদি ফিট না হয়ে খেলে, তাহলে কিন্তু সে দল ও দেশের সাথে প্রতারণা করছে। এটা শুধু তামিম না অন্য যে কারো ক্ষেত্রে হলে একই কথা বলতাম। কারণ আমি যদি একজন খেলোয়াড়ের ফিটনেসের ব্যাপারে নিশ্চিত না হই, তাহলে আমার জন্য দল নির্বাচন করা কঠিন। এমন প্লেয়ার আমি মনে করি না টিমে দরকার আছে।’

তামিম ইকবালের বিশ্বকাপের ক’দিন আগে অধিনায়কত্ব ছেড়ে দেয়ারও কড়া সমালোচনা করেন সাকিব। সাকিব জানান, তিনি নিজে অধিনায়কের দায়িত্ব নিতে মোটেই আগ্রহী ছিলেন না। একরকম বাধ্য হয়েই এই দায়িত্ব নিয়েছেন এবং শুধু বিশ্বকাপ পর্যন্তই তিনি বাংলাদেশ দলের ওয়ানডে অধিনায়ক থাকতে চান।

তামিম ইকবালের সাথে তার ব্যক্তিগত সম্পর্ক নিয়েও কথা বলেন সাকিব। তারা দুজন কি কোনো কথা বলেন না ড্রেসিং রুমে? এমন প্রশ্নে পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে দেন সাকিব, ‘এটা কি দলে কোনো প্রভাব ফেলেছে? আমার কাছে তো কখনো মনে হয়নি।’

সাক্ষাৎকারের এক পর্যায়ে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড ও সভাপতি নাজমুল হাসান পাপনেরও সমালোচনা করেন সাকিব, বিভিন্ন সময় দলের ভেতরের বিষয় প্রকাশ্যে খোলামেলা আলোচনার জন্য।

তামিম ইকবাল যা বলেছিলেন
চলমান নানা বিতর্কের মাঝে বুধবার সকালে নিজের ফেসবুক পেজে তামিম ইকবাল লেখেন, বাংলাদেশ জাতীয় দল ভারতের উদ্দেশে রওনা দেয়ার পর একটি ভিডিও বার্তার মাধ্যমে বিগত কয়েক দিনের ঘটে যাওয়া ব্যাপারে কিছু কথা বলবেন।

বাংলাদেশ দল বিকেল ৪টার ফ্লাইটে ঢাকা ছাড়ে। এর কিছু পরে ১২ মিনিটের এক ভিডিও প্রকাশ করেন তামিম ইকবাল।

সেখানে তিনি দাবি করেন, তাকে বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচ খেলতে নিষেধ করা হয়েছিল কিংবা তিনি যদি প্রথম ম্যাচে খেলেন তাহলে তাকে ওপেনিংয়ের পরিবর্তে নিচের দিকে খেলতে বলা হয়।

বাংলাদেশের এই তারকা ব্যাটসম্যান বলেন, ক্রিকেট বোর্ডের একজন ‘ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা’ তাকে সরাসরি টেলিফোন করে এসব কথা বলেছেন। এর জের ধরে তিনি বিশ্বকাপ দল থেকে ‘বাদ পড়েছেন’।

তবে বিসিবির কোন কর্মকর্তাকে তাকে ফোন করেছিলেন সেটি নিয়ে কিছু বলেননি তামিম।

তিনি বলেন, বিশ্বকাপ দল থেকে বাদ পড়ার কারণ হিসেবে তার ইনজুরির যে বিষয়টা এর আগে মিডিয়াতে এসেছে তা ঠিক নয়।

এছাড়া তিনি পাঁচ ম্যাচের বেশি খেলতে পারবেন না- বলেও যে খবর এসেছে সে বিষয়টিও ঠিক নয় বলে জানান তিনি।

তিনি বলেন, ‘মিডিয়াতে যেটা আসতেছে যে ইনজুরি বা পাঁচ ম্যাচ, আমার মনে হয় না যে ওয়ার্ল্ড কাপে না যাওয়ার পেছনে এটার কোনো বড় অবদান ছিল। কারণ আমি এখনো ইনজুরড হইনি এখনো, ব্যথা থাকতে পারে কিন্তু ইনজুরড হইনি এখনো।’

তাকে প্রথম ম্যাচ খেলা থেকে বিরত থাকা বা নিচের দিকে ব্যাটিং করার বিষয়টি তিনি ভালোভাবে নেননি উল্লেখ করে বলেন, ‘আমি উত্তেজিত হয়ে গেসিলাম। কারণ আমার বিষয়টি পছন্দ হয়নি। কারণ আমার মনে হয়েছে যে আমাকে জোর করে করে অনেক জায়গায় বাধা দেয়া হচ্ছে ইচ্ছা করে করে। তখন আমি বললাম, আপনারা একটা কাজ করেন, আপনাদের যদি এমন চিন্তা ধারা থাকে তাহলে আপনারা আমাকে পাঠায়েন না। আমি এই নোংরামির মধ্যে থাকতে চাই না। প্রতিদিন একেকটা নতুন জিনিস আপনারা আমাকে ফেস করাবেন, আমি এইটার মধ্যে থাকতে চাই না।

সাকিব-তামিম ইস্যু বিশ্বকাপে কতেটা প্রভাব ফেলবে
যেকোনো বড় টুর্নামেন্টের আগে প্রায়ই বাংলাদেশ দল শিরোনাম হয় মাঠের বাইরের ঘটনায়। তবে নাজমুল আবেদীন ফাহিম মনে করেন, এবারেই সবচেয়ে বড় ঘটনা ঘটল।

তিনি বলেন, ‘শুধু ক্রিকেটের ক্ষতি হলো তাই না, আমাদের ইমেজটাও ক্ষতিগ্রস্ত হলো আন্তর্জাতিকভাবে। সবচেয়ে ভালো হতো যদি এই পুরো বিষয়টা কনফিডেনশিয়াল থাকতে এবং সেভাবেই সমাধান হতো।’

এক্ষেত্রে ক্রিকেট বোর্ডেরও দায় দেখেন তিনি।

তিনি জানান, ‘ক্রিকেট বোর্ডের খুবই দুর্বল ভূমিকা ছিল। একটা জিনিস ঘনীভূত হচ্ছে, দলে কে থাকবে কে থাকবে না, এসব বিষয় নিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেয়ার ক্ষমতা বোর্ডের থাকা উচিত ছিল। একটা কৌশল থাকা উচিত ছিল। সেটা তো পারেনি, উল্টা সবকিছু নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেল।’

অন্যদিকে এসব ঘটনায় রীতিমতো নিজের বিরক্তি প্রকাশ করেন সাবেক ক্রিকেটার খালেদ মাসুদ পাইলট।

তিনি মন্তব্য করেন, ‘নাটকের মতো সব ঘটনা। এভাবে টিম বিশ্বকাপ খেলতে যাবে? বাংলাদেশের পরিকল্পনা, প্রস্তুতি একেবারে জঘন্য।’

তিনি সাকিব-তামিমের এই বিষয় কিভাবে এত দূর গেল, সামাজিক যোগাযোগমমাধ্যমে কেন এলা নানান উড়ো খবর, সেসবের তদন্ত করার আহ্বান জানান বিসিবির কাছে। কিন্তু পরক্ষণেই তিনি বলেন, ‘ক্রিকেট বোর্ড সেটা করবে না। কারণ তাদের অনেকেই জড়িত। এক-দুজন আছে যারা ক্রিকেট বোর্ড ভাইরাসের মতো।’

এটা অন্য তরুণ ক্রিকেটারদের মনস্তত্বেও মারাত্মক প্রভাব ফেলবে বলে মনে করেন নাজমুল আবেদীন।

তিনি বলেন, ‘বাকিরা এখন খুব সাবধানে পা ফেলবে। বুঝে গেল যে এই জগতটা আলাদা, এখানে মন খুলে কথা বলতে পারবে না, সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না।’

এই ক্রিকেট কোচ মনে করেন, এটা মোটেই কোনো দলের জন্য আদর্শ পরিবেশ নয়। কারণ পারস্পরিক নির্ভরতা আর বিশ্বস্ততা খুব জরুরি একটা দলের জন্য। আর বাংলাদেশ দলের এখন সেখানে ব্যাঘাত ঘটে গেল। সূত্র : বিবিসি