আজ মহান মে দিবস

শ্রম আইনের বিশেষ সুবিধা থেকে বঞ্চিত শ্রমিকরা

শ্রম আইনের বিশেষ সুবিধা থেকে বঞ্চিত শ্রমিকরা

শ্রমিকদের সুবিধার কথা বিবেচনা করে সরকার তৈরি করেছে শ্রম আইন। কিন্তু আইনের বিশেষ সুবিধা কপালে জুটছে না শ্রমিকদের। মামলা নিষ্পত্তিতে সময় বেঁধে দেওয়া হলেও বছরের পর বছর অপেক্ষা করেও বিচার পাচ্ছেন না শ্রমিকরা। আবার শ্রম আদালতের যে কোনো আদেশের বিরুদ্ধে মালিকপক্ষ হাইকোর্টে গিয়ে সময়ক্ষেপণ করছেন। এতে শ্রমিকদের দুর্ভোগ যেমন বাড়ছে তেমনি ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন তারা।

শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনাল হাইকোর্টের একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতির নেতৃত্বে গঠন করা হয়। এটি হাইকোর্টের সমমর্যাদার। এর পরও আপিল ট্রাইব্যুনালের আদেশের বিরুদ্ধে মালিকপক্ষ হাইকোর্টে আপিল করেন। এতে হাইকোর্ট একটি অতিরিক্ত ফোরাম হয়ে দাঁড়িয়েছে শ্রমিকদের জন্য। এমনই নানা কারণে শ্রম আইনের বিশেষ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন শ্রমিকরা।

বর্তমানে দেশের ১০টি শ্রম আদালতে ১৫ হাজারের মতো মামলা বিচারাধীন রয়েছে। এর মধ্যে পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে বিচারাধীন মামলাও আছে। শ্রম আদালতের সংখ্যা কম হওয়ার পাশাপাশি শ্রম আইনের দুর্বলতা এ মামলার জটিলতার কারণ বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। শ্রম আইনের ২১৬ ধারার উপ-ধারা (১২)-তে বলা হয়েছে, ‘শ্রম আদালতের রায়, সিদ্ধান্ত বা রোয়েদাদ; প্রত্যেক ক্ষেত্রে মামলা দায়ের করিবার তারিখ হইতে ৬০ (ষাট) দিনের মধ্যে প্রদান করিতে হইবে।’ উপ-ধারা (১৩)-তে বলা হয়েছে, ‘উপ-ধারা (১২) এর বিধান সত্ত্বেও, ৬০ (ষাট) দিনের নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে রায়, সিদ্ধান্ত বা রোয়েদাদ প্রদান করা সম্ভব না হইলে, উপযুক্ত কারণ লিপিবদ্ধ করিয়া আদালত উক্ত সময়সীমা আরো ৯০ (নব্বই) দিন বর্ধিত করিতে পারিবে।’ শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনালের ক্ষেত্রেও একই সময়সীমা দেওয়া আছে। সে অনুযায়ী শ্রম আদালতে একটি মামলা নিষ্পত্তি করতে সর্বোচ্চ পাঁচ মাস সময় লাগার কথা। কিন্তু দেখা যাচ্ছে বছরের পর বছর পার হয়ে গেলেও মামলা নিষ্পত্তি হচ্ছে না।

এ ব্যাপারে লেবার কোর্ট লইয়ার্স সোসাইটির সেক্রেটারি অ্যাডভোকেট রফিকুল ইসলাম খান বলেন, শ্রম আইনটি বিশেষ আইন, শ্রমিকদের বিশেষ স্বার্থে এটা করা হয়েছে। তবে দেওয়ানি যে বিধান রয়েছে, সেটাও শ্রম আদালতের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। ফলে মামলা নিষ্পত্তির নির্ধারিত যে সময়সীমা শ্রম আইনে উল্লেখ রয়েছে, সেখানে দেওয়ানি বিধান চালু থাকায় মামলার পক্ষগণ দীর্ঘসূত্রিতার সুযোগটা নিয়ে থাকেন। তা ছাড়া মামলার যে জট রয়েছে, তাতে শ্রম আদালতও নির্ধারিত সময়ে মামলা শেষ করতে পারেন না।

তিনি আরও বলেন, শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান নিয়োগ করা হয় হাইকোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিকে। কিন্তু দেখা যায়, শ্রম আদালত বা শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনালের আদেশে সংক্ষুব্ধরা হাইকোর্টকে অনেক সময় আপিল কোর্ট হিসেবে বেছে নেয়, আবার অনেক সময় রিট ফোরামেও হাইকোর্টে যায়। এভাবে মূলত সময়ক্ষেপণের সুযোগ নেয়। এতে শ্রম আদালতে মামলা নিষ্পত্তি বিলম্বিত হচ্ছে। এই আইনজীবী তার অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বলেন, আমি নিজে দেখেছি, সময়ক্ষেপণের কারণে আর মামলার বাদীকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। কারণ শ্রম আদালতে আসে বেশিরভাগই অসহায়-গরিব শ্রমিক। চাকরিচ্যুত হওয়ার পর তারা শ্রম আদালতে মামলা করে। কিন্তু যখন মালিকপক্ষ হাইকোর্টে গিয়ে দীর্ঘসূত্রিতার মুখে ফেলে দেয়, তখন আর ওই শ্রমিক মামলা চালাতে পারে না। দু-তিন বছর পার হয়ে গেলে আর মামলার বাদীকে খুঁজে পাওয়া যায় না।

হাইকোর্টের একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতির নেতৃত্বে শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়। শ্রম আইনের ২১৮ ধারার ১২ উপ-ধারায় বলা হয়েছে, ‘ট্রাইব্যুনাল উহার অথবা কোনো শ্রম আদালতের অবমাননার জন্য শাস্তি দিতে পারিবে, যেন উহা সুপ্রিমকোর্টের একটি হাইকোর্ট বিভাগ।’ হাইকোর্ট বিভাগের সমমর্যাদার হলেও ট্রাইব্যুনালের রায়ে সংক্ষুব্ধ মালিকপক্ষ আপিল করেন হাইকোর্টে। আবার হাইকোর্টও সেই আপিল শুনানির জন্য গ্রহণ করেন, যা শ্রমিকদের ন্যায়বিচারের সঙ্গে তামাশা বলে মনে করেন অনেকেই।

আইনজীবীদের মতে, শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনালের আদেশ বা রায়ে সংক্ষুব্ধ হলে সরাসরি আপিল বিভাগে যেতে হবে। যেমনটি করা হয় প্রশাসনিক আপিল ট্রাইব্যুনালে। সরকারি চাকরিজীবীদের জন্য গঠিত প্রশাসনিক আপিল ট্রাইব্যুনালের রায়ে কেউ সংক্ষুব্ধ হলে হাইকোর্টে যাওয়ার সুযোগ থাকে না, যেতে হয় আপিল বিভাগে। প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনালের রায় ও আদেশের বিরুদ্ধেও এখন কেউ হাইকোর্টে যেতে পারে না। শ্রম আদালত ও শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনালের ক্ষেত্রেও এই বিধান চালু করা জরুরি। এ ক্ষেত্রে আইনের সামান্য পরিবর্তন আনা প্রয়োজন বলে মনে করেন আইনজীবীরা।

শ্রমিকদের নিয়ে কাজ করে এমন একটি সংগঠন একতা গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের সেক্রেটারি কামরুল হাসান বলেন, শ্রম আইন শ্রমিকদের জন্য সুফল বয়ে আনছে না। বিশেষ করে মামলার দীর্ঘসূত্রিতার মুখে পড়ে শ্রমিকরা হতাশ হয়ে পড়ছেন।

শ্রম আদালতের একজন কর্মকর্তা বলেন, শ্রম আদালতে প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের নিয়োগ দেয় শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় আর বিচারক নিয়োগের বিষয়টি আইন মন্ত্রণালয়ের হাতে। আবার আইনে শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যানকে শ্রম আদালত ও শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনালের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। এর ফলে এক ধরনের দ্বৈত শাসন সৃষ্টি হয়ে আছে। এ ছাড়া প্রয়োজনীয় লোকবল নেই, পদোন্নতির বিধান নেই। এর ওপর শ্রম আদালত ও আপিল ট্রাইব্যুনালের ওপর রয়েছে শ্রম মন্ত্রণালয়ের খবরদারি। শ্রমিকদের কল্যাণে এসব বিষয়েও নজর দেওয়া জরুরি।

এমজে/