প্রবাসী শ্রমিকরা চাকরি হারানোয় আর্থিক সংকটে দেশে থাকা পরিবার

প্রবাসী শ্রমিকরা চাকরি হারানোয় আর্থিক সংকটে দেশে থাকা পরিবার

বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের যেসব শ্রমিক কাজ করেন তারা তাদের আয়ের একটি বড় অংশ দেশে পরিবারের কাছে পাঠিয়ে দেন। এখন ওই দেশগুলোয় লকডাউনের কারণে এরই মধ্যে অনেক শ্রমিক চাকরি হারিয়েছেন, বেতন-ভাতা পাচ্ছেন না।

এমন অবস্থায় আর্থিক সংকটের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে তাদের আয়ের ওপর নির্ভরশীল পরিবারগুলো।

সৌদি আরবের রিয়াদ শহরের একটি স্যালনে গত আড়াই বছর ধরে কাজ করতেন বিধান চন্দ্র শর্মা।

করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে সৌদি আরব সরকার লকডাউন ঘোষণা পর পর সবার আগে স্যালনগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়। এমন অবস্থায় তিন মাস ধরে কর্মহীন হয়ে আছেন তিনি।

দেশে টাকা পাঠানো দূরে থাক। তিন বেলা খাওয়ার মতো টাকাও এখন তার কাছে নেই।

কবে চাকরি পাবেন সেটা নিয়েও অনিশ্চয়তায় আছেন তার মতো এমন অসংখ্য শ্রমিক।

মি. শর্মা বলেন "দোকান বন্ধ মানে চাকরি নাই। মালিকেও খোঁজ খবর নেয় না। এম্বাসির সাথেও যোগাযোগ করতে পারতেসি না। খুব কষ্ট করে খাইতেসি।"

মি. শর্মার পাঠানো টাকার ওপর নির্ভর করে চলে বাংলাদেশে থাকা তার আট সদস্যের পরিবার।

গত দুই মাস কোন টাকা না পাঠানোয় এই পরিবারটিও তীব্র অভাব অনটনের মুখে পড়েছে।

স্বামী চাকরি হারানোয় সামনের দিনগুলো কিভাবে চলবেন সেটাই ভেবে পাচ্ছেন না স্ত্রী শুক্লা রানী শীল।

"আমার শাশুড়ির চিকিৎসা আমাদের খাওয়া দাওয়া সব আমার স্বামীর টাকায় চলে। আমার ভাসুরও বেকার। আজকে তিন মাস স্বামী কোন টাকা পাঠাইতে পারে না, ফ্যামিলি চালাইতে পারে না। ধারকর্য করে চলতেসি।"

লকডাউনের কী প্রভাব পড়ছে বাংলাদেশের শ্রমবাজারের ওপর?

করোনাভাইরাস: 'দেশে হাত পাততে পারতেছি না, বলতেও পারতেছি না'

 

প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের দেওয়া তথ্য মতে, বিশ্বের ১৬৯টি দেশে বাংলাদেশের ১ কোটি ২০ লাখের মতো শ্রমিক রয়েছে।

এর মধ্যে প্রায় ৭৫ শতাংশই মধ্যপ্রাচ্যের ৬টি দেশে থাকে।

এই দেশগুলোয় গত তিন মাসের বেশি সময় ধরে লকডাউন চলায় তাদের তেল-নির্ভর অর্থনীতি এক প্রকার স্থবির হয়ে পড়েছে।

এরই মধ্যে চাকরি থেকে ছাঁটাই করে দেশে ফিরে যেতে শ্রমিকদের বাধ্য করা হচ্ছে।

লকডাউনের পর এই শ্রমিকরা তাদের চাকরি ফেরত পাবেন কি না, আবার যাদের চাকরি আছে তারা টিকে থাকতে পারবেন কিনা সেটা নিয়েও সংশয় দেখা দিয়েছে।

দ্রুত কোন ব্যবস্থা না নিলে এই মানুষগুলোর কর্মসংস্থান পুনরুদ্ধার করা কঠিন হয়ে পড়বে বলে আশঙ্কা করছেন অভিবাসন বিষয়ক সংস্থা রামরুর চেয়ারম্যান তাসনিম সিদ্দিকি।

তিনি বলেন, "তেলের দাম পড়ে যাওয়ায় যে সংকট তৈরি হয়েছে, এসব দেশ অভিবাসী শ্রমিক কমিয়ে সেই খরচ কমানোর চেষ্টা করবে।"

মিসেস সিদ্দিকির মতে, করোনাভাইরাসের এই প্রাদুর্ভাবের সময়ে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টির কোন সম্ভাবনা নেই।

যারা ফ্রি ভিসায় আছেন তাদেরও কোন কাজ নেই। আবার যাদের চাকরি আছে তারাও বেতনের ২০ থেকে ৩০ শতাংশ পাচ্ছে ন। ভবিষ্যতে এই টাকাও পাবেন কি না সেটারও কোন নিশ্চয়তা নেই।

এই মানুষগুলো মসজিদে থাকছেন এবং মসজিদের চ্যারিটির খাবার খেয়ে টিকে থাকার চেষ্টা করছেন বলে তিনি জানান।

শ্রমিকদের আয়ের ওপর নির্ভরশীল বাংলাদেশের পরিবারগুলো খাদ্য সংকটের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে উল্লেখ করে মিসেস সিদ্দিকি বলেন, এই সংকটকালীন সময়ে প্রবাসী অভিবাসীদের অনেক পরিবার দারিদ্র সীমার নিচে চলে যেতে পারে।

প্রবাসী শ্রমিকদের পাঠানো রেমিটেন্সের পরিমাণ উল্লেখযোগ্য হারে কমে যাওয়ায় বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব পড়তে পারে বলে আশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের।

কারণ বাংলাদেশের অর্থনীতির একটি বড় অংশ শ্রমিকদের পাঠানো রেমিটেন্সের ওপর নির্ভরশীল। তাই ওই দেশগুলোর লকডাউনের প্রভাব সার্বিকভাবে জিডিপিতেও পড়েছে।

চলতি বছর বাংলাদেশে এই রেমিটেন্সের হার ২২% কমে যাবে বলে আশঙ্কা করছে বিশ্বব্যাংক।

বাংলাদেশের ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী গত এপ্রিল মাসে প্রবাসীরা যে পরিমাণ রেমিটেন্স পাঠিয়েছে সেটা বিগত ১৫ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন।

এমন অবস্থায় প্রবাসী শ্রমিক ও তাদের পরিবারগুলোর সহায়তায় একটি কর্মপরিকল্পনা তৈরি করার কথা জানিয়েছেন প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব মোহাম্মদ আহমেদ মনিরুছ সালেহীন।

বর্তমানে বিশ্বের ২৬টি দেশে বাংলাদেশের যে ২৯টি মিশন আছে, সেখানকার লেবার উইং, এই অভিবাসী শ্রমিকদের খাবার সরবরাহসহ আরও নানা সহায়তা দিচ্ছে বলে তিনি জানান। এজন্য সরকারের পক্ষ থেকে ১০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।

যারা দেশে ফেরত আসছেন তাদের বিমানবন্দরে ৫০০০ টাকা সহায়তা দেয়া হচ্ছে।

সরকারের পক্ষ থেকে ২০০ কোটি টাকার একটি ঋণ প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে জানিয়ে মি. সালেহীন বলেন, এই প্রকল্পের আওতায় এই অভিবাসী শ্রমিকদের সহজ শর্তে ৪% সুদে এক লাখ থেকে ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ দেয়া হবে।

করোনাভাইরাস পরবর্তী পরিস্থিতিতে নির্মাণ শ্রমিক ছাঁটাই করা হলেও পরিচ্ছন্নতা খাতে বিপুল পরিমাণ শ্রমিকের চাহিদা তৈরি হবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

বাংলাদেশি শ্রমিকদের দিয়ে সেই চাহিদা পূরণ করা গেলে রেমিটেন্সের প্রবাহ স্বাভাবিক রাখা সম্ভব হবে বলে তারা জানিয়েছেন।