টেক জায়ান্ট ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানগুলোর চিঠি

বিটিআরসির খসড়া প্রবিধান বাক্‌স্বাধীনতার জন্য হুমকি

বিটিআরসির খসড়া প্রবিধান বাক্‌স্বাধীনতার জন্য হুমকি

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) খসড়া প্রবিধানকে বাক্‌স্বাধীনতার জন্য হুমকি মনে করছে গ্লোবাল নেটওয়ার্ক ইনিশিয়েটিভ (জিএনআই)। বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় প্রযুক্তি কোম্পানি ও মানবাধিকার সংগঠনগুলোর এই প্ল্যাটফর্ম বলছে, এই প্রবিধান প্রয়োগ হলে পরিষেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর কনটেন্ট নিয়ন্ত্রণ ও তথ্য দেওয়ার জন্য অযৌক্তিক চাপ তৈরি হবে।

গ্লোবাল নেটওয়ার্ক ইনিশিয়েটিভে ফেসবুকের মালিকানা প্রতিষ্ঠান মেটা, গুগল, মাইক্রোসফট, উবার, জুম, টেলিনর গ্রুপ, ইয়াহু, নকিয়া, ভোডাফোন, ভ্যারাইজন ছাড়াও হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, উইকিমিডিয়া, কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টসহ বিভিন্ন সংস্থা রয়েছে। ৯ মার্চ বিটিআরসিকে চিঠি পাঠিয়ে ‘ডিজিটাল, সোশ্যাল মিডিয়া এবং ওটিটি প্ল্যাটফর্মের জন্য বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন রেগুলেশন-২০২১’–এর খসড়া নিয়ে উদ্বেগের কথা জানিয়েছে তারা। জিএনআইয়ের ওয়েবসাইটে চিঠিটি প্রকাশ করা হয়েছে।

জিএনআই ২০২০ সালে ‘কনটেন্ট রেগুলেশন অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস’ নামে একটি পলিসি ব্রিফ চালু করে। এর আলোকে বিটিআরসির খসড়া প্রবিধানটি পর্যালোচনা করা হয়েছে। জিএনআই বলছে, তারা খসড়ার বিস্তৃত পরিধি নিয়ে উদ্বিগ্ন। এর আওতায় কোন কোন কোম্পানি আসবে এবং বিষয়বস্তু কী কী হবে, তা নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে। ব্যবহারকারীকে খুঁজে বের করা (ট্রেসেবিলিটি) ও তথ্য বিনিময় নিয়ে বাধ্যবাধকতা এবং এ বিষয় বাস্তবায়নকারী কর্তৃপক্ষ নিয়ে অস্পষ্টতা রয়েছে। এর ফলে জনসাধারণের ব্যক্তিগত গোপনীয়তার অধিকার ক্ষুণ্ন হতে পারে।

প্ল্যাটফর্মটি বলছে, এই নীতির বিষয়ে বেসরকারি অংশীদারদের সঙ্গে আরও পরামর্শ করা প্রয়োজন। তারা বিটিআরসিকে বিশেষজ্ঞ ও সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে কাজ করারও আহ্বান জানিয়েছে। তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ও সম্প্রতি ওটিটি প্ল্যাটফর্মগুলোর জন্য খসড়া নীতিমালা প্রকাশ করেছে। জিএনআই সে বিষয়েও কিছু বিষয় আরও স্পষ্ট করা ও পর্যালোচনার আহ্বান জানিয়েছে।

জিএনআই তাদের চিঠিতে যেসব ক্ষেত্রে উদ্বেগ জানিয়েছে, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে—

খসড়া প্রবিধানের বেশ কয়েকটি জায়গা অসম্পূর্ণ, গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো অনির্ধারিত রেখে দেওয়া হয়েছে এবং ভারতের তথ্যপ্রযুক্তি নীতি, ২০২১ থেকে এনে বসানো হয়েছে।

কনটেন্ট নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে বিটিআরসি ও তথ্য মন্ত্রণালয় কর্তৃপক্ষকে আরও ভালোভাবে ব্যাখ্যা করা প্রয়োজন। সরকারের দুই সংস্থার খসড়া নীতিমালায় ‘ডিজিটাল মিডিয়া কোড অব এথিকস’ করা হয়েছে। যেখানে ‘অনলাইন কিউরেটেড কনটেন্টের প্রকাশক’ এবং ‘সংবাদ ও ঘটনাবলির প্রকাশকদের’ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। তাদের এই সংজ্ঞা আইসিটি কোম্পানিগুলোর ওপরও প্রয়োগ হতে পারে।

খসড়া প্রবিধান দুটি বাংলাদেশে পরিষেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান ও ব্যবসায়িক মডেলগুলোর ওপর আইনি বাধ্যবাধকতা তৈরি করবে।

এ ধরনের নীতি প্রয়োগ হলে কনটেন্ট অপসারণের মাত্রা বেড়ে যাবে এবং ব্যবহারকারীর আত্মনিয়ন্ত্রণ (সেলফ সেন্সরশিপ) বাড়বে। পাশাপাশি ব্যবহারকারী ও পরিষেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বিশ্বাসের ঘাটতি তৈরির আশঙ্কা রয়েছে।

কোনো পর্যালোচনা বা আপিলের সুযোগ ছাড়াই প্রবিধানে বিটিআরসিকে একতরফা কনটেন্ট অপসারণের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া ৭২ ঘণ্টার মধ্যে কনটেন্ট অপসারণের নির্দেশ, মধ্যস্থতাকারীদের সঠিকভাবে পর্যালোচনা ও প্রতিক্রিয়া জানানোর পর্যাপ্ত সময় থাকবে না।

পরিষেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের লক্ষ্য করে খসড়া প্রবিধানে নীতি লঙ্ঘনের জন্য অত্যধিক জরিমানা রয়েছে। এতে ৩৫ মিলিয়ন ডলার বা ৫ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে।

কনটেন্ট অপসারণের বিষয়ে সরকারি সংস্থাগুলোকে অত্যধিক কর্তৃত্ব দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া জরুরি পরিস্থিতিতে কোনো শুনানির সুযোগ ছাড়াই কনটেন্ট ব্লক করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে।

এ ধরনের নীতি মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি তৈরি করবে এবং অনিশ্চয়তার দিকে নিয়ে যাবে। পাশাপাশি কোম্পানিগুলোর প্রতিনিধিদের জন্য তাঁদের ব্যবহারকারীদের মত প্রকাশের স্বাধীনতা এবং গোপনীয়তার অধিকারকে সম্মান করা কঠিন করে তুলবে।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো বার্তা আদান–প্রদানে এন্ড-টু-এন্ড এনক্রিপশন নিশ্চিত করে। যেখানে বার্তার প্রেরক ও প্রাপকই কেবল বার্তাগুলো দেখতে পারে। কিন্তু খসড়ায় বার্তার উৎস ও শনাক্তকরণের কথা বলা হয়েছে। এই নীতি প্রয়োগ হলে কোম্পানিগুলোকে এনক্রিপশন ভাঙতে হবে এবং ব্যবহারকারীর বার্তা সরকারের নজরদারি সংস্থার কাছে প্রকাশ করার বাধ্যবাধকতা তৈরি হবে। এনক্রিপশন ভঙ্গ করা বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী নাগরিকদের গোপনীয়তা লঙ্ঘিত হবে।