আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার দিবস

অপরাধ যেখানেই হোক, কেউ বিচারের ঊর্ধ্বে নয়

অপরাধ যেখানেই হোক, কেউ বিচারের ঊর্ধ্বে নয়

আজ ১৭ জুলাই, আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার দিবস। অপরাধ যে সময়ই হোক, আর যে স্থানেই হোক, মানুষ যেন বিচার পেতে পারে, সেই ধারণা প্রতিষ্ঠিত করতে বিশ্বব্যাপী প্রতিবছর এই দিবসটি পালন করা হয়। এ বছর দিবসটির মূল প্রতিপাদ্য হচ্ছে—‘আনুষ্ঠানিক কর্মসংস্থানের মাধ্যমে সামাজিক ন্যায়বিচার অর্জন’।

আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার দিবসের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) প্রতিষ্ঠার বিষয়টি। নানা পথপরিক্রমায় ১৯৯৮ সালের ১৭ জুলাই ১২০টি দেশের ভোটে ‘রোম সংবিধি’ অনুমোদিত হয়। রোম সংবিধির মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয় আইসিসি। এ কারণে ১৭ জুলাই আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার দিবস পালন করা হয়।

‘রোম সংবিধি’ হলো আইসিসির মূল ভিত্তি। এই সংবিধি অনুযায়ী, আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত গঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ২০০২ সালের ১ জুলাই থেকে আইসিসির কার্যক্রম শুরু হয়। নেদারল্যান্ডসের দ্য হেগ শহর থেকে এই আদালতের কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে।

আন্তর্জাতিক বিচার আদালতের (আইসিজে) মতো আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) সরাসরি জাতিসংঘের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়। এটি একটি আন্তরাষ্ট্রীয় সংস্থা। যার বর্তমান সদস্য সংখ্যা ১২৩।

আইসিসি গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ, মানবতাবিরোধী অপরাধ, আগ্রাসনের মতো বিষয়গুলো আমলে নিয়ে থাকেন। যখন কোনো দেশ এ ধরনের অপরাধের সঙ্গে যুক্ত কোনো ব্যক্তি বা সংগঠনের বিচার করে না, কিংবা করতে অপারগতা প্রকাশ করে, তখন আইসিসি তা আমলে নিতে পারেন। কোনো রাষ্ট্রের বিচার করার এখতিয়ার আইসিসির নেই। তবে তা আছে আইসিজের।

বাংলাদেশের ক্ষেত্রে আইসিসির প্রাসঙ্গিকতা
১৯৯৯ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ ‘রোম সংবিধির’ সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে। ২০১০ সালে রোম সংবিধি অনুস্বাক্ষর করে বাংলাদেশ।

আইসিসির এখতিয়ারাধীন বেশ কিছু কর্মকাণ্ডের সঙ্গে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিষয়গত মিল থাকলেও সরাসরি কোনো সম্পর্ক নেই। কারণ, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধকালে সংঘটিত গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার করার ক্ষেত্রে রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ নিজেই তার সক্ষমতা দেখিয়েছে। তবে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে আইসিসির প্রাসঙ্গিকতা রয়েছে অন্যভাবে। সেটি হলো—রোহিঙ্গা ইস্যু।

মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর দমন-পীড়নের মুখে ২০১৬ সালের অক্টোবরে প্রায় লাখখানেক এবং ২০১৭ সালের আগস্টের পর প্রায় সাত লাখ রোহিঙ্গা রাখাইন থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়।

২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে আইসিসি রোহিঙ্গাদের মিয়ানমার থেকে জোর করে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেওয়া এবং এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ তদন্তের উদ্যোগ নেন।

মিয়ানমার ‘রোম সংবিধি’ স্বাক্ষরকারী দেশ নয়—এমন যুক্তি দিয়ে তখন আইসিসির এখতিয়ার নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছিল। কিন্তু তখন আইসিসির পক্ষ থেকে বলা হয়, মিয়ানমার আইসিসির সদস্য না হলেও রোহিঙ্গারা সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়া বাংলাদেশ আইসিসির সদস্য। তাই এ ঘটনার তদন্ত ও বিচারের এখতিয়ার আইসিসির রয়েছে।

গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে মিয়ানমারে ক্ষমতার পটপরিবর্তন হয়। নির্বাচিত সরকার উৎখাত করে ক্ষমতা দখল করে দেশটির সেনাবাহিনী। এতে মিয়ানমারের পরিস্থিতি পাল্টে যায়।

২০২১ সালের আগস্টে মিয়ানমারের জান্তা শাসনবিরোধী ‘জাতীয় ঐক্যের সরকার’ আইসিসির এখতিয়ার মেনে নেওয়ার ঘোষণা দেয়।

এদিকে রোহিঙ্গা ইস্যুতে আইসিসির তদন্তে বেশ কিছু অগ্রগতি হয়েছে। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে সংস্থার প্রধান কৌঁসুলি করিম খান বাংলাদেশ সফর করেন। তখন তিনি মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে অপরাধের প্রমাণ সংগ্রহে বাংলাদেশের সহযোগিতায় সন্তোষ প্রকাশ করেন।

করিম খানের সফরের পর রোহিঙ্গাদের সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস বাংলাদেশে আইসিসির ‘উপ-আদালত’ করতে সংস্থাটির কাছে একটি চিঠি পাঠায়।

আইসিসির ক্ষমতা ও বাস্তবতা
আইসিসি বিচারের মাধ্যমে যেকোনো ব্যক্তি বা সংগঠনকে দোষী সাব্যস্ত করতে পারেন। এমনকি গ্রেপ্তারি পরোয়ানাও জারি করতে পারেন। তবে নিজস্ব কোনো বাহিনী না থাকায় অভিযুক্ত ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার বা দণ্ড কার্যকর করতে পারেন না আইসিসি।

এ জন্য সংস্থাটি সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্র ও অপরাপর অন্য রাষ্ট্রকে অভিযুক্ত ব্যক্তি বা ব্যক্তিদের গ্রেপ্তারের আহ্বান জানান। রাশিয়া, চীন, ভারত, যুক্তরাষ্ট্রসহ ৪০টির মতো দেশ আইসিসিকে এখনো স্বীকৃতি দেয়নি। এসব সীমাবদ্ধতার কারণে এই আইসিসির কর্মকাণ্ড বেশ সীমিত। বিচারপ্রক্রিয়াও বেশ ধীর।

আইসিসি মনে করেন, কোনো রাষ্ট্রের সীমানার মধ্যে সংঘটিত অপরাধের বিচার করার এখতিয়ার ও দায়িত্ব মূলত সেই রাষ্ট্রেরই। কিন্তু কোনো কারণে রাষ্ট্র যদি সেই দায়িত্ব পালন না করে, বা ব্যর্থ হয়, তখন আইসিসি কিছু সুনির্দিষ্ট অপরাধ আমলে নিয়ে বিচার করতে পারেন।

অপরাধ যেখানেই হোক, আর যে সময়েই হোক, কেউই বিচারের ঊর্ধ্বে নয়—এই স্পিরিট বা চেতনা প্রতিষ্ঠা করতে চায় আইসিসি। এই চেতনা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দিতে আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার দিবস একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন।