একটি মামলায় বিএনপি নেতাদের যেভাবে আসামি করল পুলিশ

একটি মামলায় বিএনপি নেতাদের যেভাবে আসামি করল পুলিশ লাঠি হাতে সড়কে স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতা–কর্মীরা। গতকাল দুপুরে রাজধানীর উত্তরার কামারপাড়া সেতু এলাকায় ছবি: আল-আমিন

ছেলেকে কুপিয়ে আহত করার ঘটনায় থানায় মামলা করতে গিয়েছিলেন এক বাবা। পুলিশ যখন জানল তাঁর ছেলে ছাত্রদলের নেতা, তখন মামলা নিতে প্রথমে অস্বীকৃতি জানায়। পরে পুলিশ তাঁকে দেড় ঘণ্টা অপেক্ষায় রেখে একটি এজাহার (মামলার বিবরণ) লিখে নিয়ে আসে।

তিনি সেই এজাহার পড়ে দেখেন, তাঁর ছেলে বিএনপির যে নেতার অনুসারী, সেই নেতার নাম লেখা হয়েছে এক নম্বর আসামি হিসেবে। অন্য আসামিরাও বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা।

রাজধানীর গেন্ডারিয়া থানায় ১০ সেপ্টেম্বর রাতে মামলাটি করতে গিয়েছিলেন ইসমাইল রহমান। তাঁর ছেলে কদমতলী থানা ছাত্রদলের যুগ্ম আহ্বায়ক আশিকুর রহমান।

১০ সেপ্টেম্বর দুপুরে রাজধানীর নয়াপল্টনের ভাসানী ভবনে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির একটি সমন্বয় সভায় অংশ নিয়েছিলেন আশিকুর।

সভা শেষে বাসায় ফেরার পথে কদমতলীর পাশে দয়াগঞ্জ ট্রাকস্ট্যান্ডের কাছে তিনিসহ ছাত্রদলের তিন নেতার ওপর অতর্কিত হামলা চালায় দুর্বৃত্তরা। একটি মাইক্রোবাস থেকে নেমে কয়েকজন তাঁদের এলোপাতাড়ি ছুরিকাঘাত করেন। পরে মাইক্রোবাসটি চলে গেলে স্থানীয় লোকজন তাঁদের উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান।

আশিকুরের সঙ্গে গুরুতর আহত হওয়া বাকি দুজন হলেন কদমতলী থানা ছাত্রদলের আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম ও কদমতলী থানার ৫৮ নম্বর ওয়ার্ড ছাত্রদলের যুগ্ম আহ্বায়ক আতিকুর রহমান।

গুরুতর আহত আশিকুর রহমানের বাবা ইসমাইল রহমান গত সোমবার রাতে মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, হামলার ঘটনার দিন রাত আটটার দিকে গেন্ডারিয়া থানায় তিনি অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিদের আসামি করে মামলা করতে গিয়েছিলেন।

কিন্তু পুলিশ তাদের মতো করে আসামির নাম বসিয়ে এজাহার লিখে সেখানে সই করতে বলেন। তখন আসামিদের নাম দেখে তিনি বলেছেন, এঁরা তো ঘটনাস্থলে ছিলেন না। তখন ওসি বলেন, আসামিরা ঘটনাস্থলে ছিলেন, সিসি ক্যামেরায় দেখা গেছে।

ইসমাইল রহমান বলেন, ‘মামলার কাগজে সই করতে না চাওয়ায় ওসি বললেন, আপনি মামলা না করলেও আমরা মামলা করব। পরে পুলিশ বিএনপি নেতাদের আসামি করে মামলা দিয়েছে বলে শুনেছি।’

তবে ইসমাইল রহমানের বক্তব্য মানতে চাইছে না পুলিশ। জানতে চাইলে গেন্ডারিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবু সাঈদ আল মামুন প্রথম আলোকে বলেন, ‘পুলিশ মনগড়া কোনো কিছু সাজাতে পারে না। এই হামলা অভ্যন্তরীণ কোন্দলের ফল। দীর্ঘদিন ধরে বিবাদীদের সঙ্গে আহত নেতাদের কোন্দল চলছে। হামলার সিসি ক্যামেরার ফুটেজ আছে।’

পুলিশের মামলায় নাম উল্লেখ করা ১৫ আসামির মধ্যে এক নম্বরে রয়েছেন ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক তানভীর আহমেদ। তাঁর বাবা সালাউদ্দীন আহমদ কদমতলী–শ্যামপুর এলাকার সাবেক সংসদ সদস্য। গুরুতর আহত তিনজন স্থানীয় রাজনীতিতে তানভীর আহমেদের অনুসারী।

১০ সেপ্টেম্বর রাত সাড়ে ১২টার দিকে পুলিশের করা ওই মামলায় আসামিদের মধ্যে আরও রয়েছেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের বর্তমান দুই কাউন্সিলরও। একজন ৫৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মীর হোসেন। তিনি কদমতলী থানা বিএনপির সাবেক সভাপতি। আরেকজন ৬১ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর জুম্মন মিয়া। তিনি যাত্রাবাড়ী থানা বিএনপির সাবেক সহসভাপতি।

অন্য আসামিরা হলেন ঢাকা দক্ষিণ সিটির ৫৩ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সদস্যসচিব দেলোয়ার হোসেন, একই ওয়ার্ডে বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক আনোয়ার হোসেন, ঢাকা দক্ষিণ সিটির ৫২ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির আহ্বায়ক মো. দিপু, ঢাকা দক্ষিণ সিটির ৬০ নম্বর বিএনপির আহ্বায়ক ইউসুফ আলী ভূঁইয়া, কদমতলী থানা যুবদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আলমগীর হোসেন। বাকি সাত আসামিও বিএনপির রাজনীতি করেন।

যে তিন ছাত্রদল নেতাকে কুপিয়ে আহত করা হয়েছে, তাঁরা হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। এর মধ্যে আশিকুরের অবস্থা গুরুতর। আহত আরেকজন আরিফুর রহমানের সঙ্গে মুঠোফোনে কথা বলেছে প্রথম আলো। তিনি বলেন, যাঁদের নামে মামলা দেওয়া হয়েছে, তাঁদের সঙ্গে তিনি রাজনীতি করেন। এই মামলা ভিত্তিহীন দাবি করে তিনি বলেন, বিএনপি নেতাদের ফাঁসাতেই এমন মামলা সাজানো হয়েছে।

আসামিদের মধ্যে তানভীর আহমেদ, দুই কাউন্সিলরসহ কেউ ঘটনাস্থলে ছিলেন না—আহত ছাত্রদল নেতার এমন বক্তব্যের বিষয়ে গেন্ডারিয়া থানার ওসি আবু সাঈদ আল মামুন প্রথম আলোকে বলেন, বিষয়টি তদন্তে উঠে আসবে। এর বেশি কিছু তিনি বলতে চাননি।

মামলার আসামি ঢাকা দক্ষিণ সিটির ৫৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মীর হোসেন গত রাতে মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘তাঁরা আমাদের কর্মী, ছাত্রদল করে, আমাদের ছোট ভাই। উল্টো পুলিশ আমাদের আসামি করেছে। এ ঘটনা কী বলব আর।’

এজাহারে পুলিশ বলেছে, ছাত্রদলের ওই তিন নেতার সঙ্গে মামলার আসামিদের নয়াপল্টনের বিএনপির কার্যালয়ে কথা–কাটাকাটি হয়। ছাত্রদল নেতারা দয়াগঞ্জ ট্রাকস্ট্যান্ডের মূল ফটকের সামনে দিয়ে রিকশা করে যাওয়ার সময় ঢাকা মহানগর বিএনপির নেতারা (মামলার আসামিরা) ধারালো চাকু ও রড দিয়ে তাঁদের রক্তাক্ত করেন।

বিএনপি নেতাদের হামলায় ছাত্রদলের নেতারা গুরুতর আহত হলে আশপাশের লোকজন এগিয়ে আসেন। তখন বিএনপি নেতারা চলে যান।

মামলায় বাদী গেন্ডারিয়া থানা–পুলিশের উপপরিদর্শক (এসআই) সাঈখ বিন-আহম্মেদ এজাহারে উল্লেখ করেন, দুর্বৃত্তরা আশিকুরের ডান কাঁধে এবং পিঠের ডান দিকে ছুরিকাঘাত করে রক্তাক্ত করেছে। আতিকুরের ডান হাতের কবজির ওপর এবং আরিফুরের বাঁ কাঁধে, পিঠের বাঁ দিকে ও বাঁ হাতের বগলের নিচে ছুরিকাঘাত করেছে।

মামলায় এক নম্বর আসামি বিএনপি নেতা তানভীর আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, যে মাইক্রোবাসে করে দুর্বৃত্তরা এসেছিল, সেই মাইক্রোবাসের নম্বর পুলিশকে আশিকুরের বাবা দিয়েছিলেন।

কিন্তু পুলিশ সেই নম্বরের সূত্র ধরে দুর্বৃত্তদের খোঁজার চেষ্টা করেনি। পুলিশ ইচ্ছে করেই তাঁকেসহ বিএনপি নেতাদের ফাঁসাতে সাজানো মামলা দিয়েছে। -প্রথম আলো