চাহিবামাত্র বিপিসির টাকা দিতে পারবে তো ব্যাংকগুলো?

চাহিবামাত্র বিপিসির টাকা দিতে পারবে তো ব্যাংকগুলো?

ব্যাংক খাতের সবচেয়ে বড় গ্রাহক প্রতিষ্ঠান বলা হয় বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনকে (বিপিসি)। মেয়াদি আমানত ও নগদ অর্থ হিসেবে দেশের সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংকগুলোয় ২৭ হাজার কোটি টাকারও বেশি অর্থ গচ্ছিত রেখেছে বিপিসি। এর মধ্যে কোনো কোনো ব্যাংকে পরিচালন ব্যয় নির্বাহের জন্য শুধু নগদ অর্থ হিসেবেই গচ্ছিত আছে আড়াই হাজার কোটি টাকার বেশি। দেশের ব্যাংক খাতের প্রতিষ্ঠানগুলো এখন তীব্র তারল্য সংকটে ভুগছে। এ অবস্থায় বিপিসি কোনো ব্যাংক থেকে প্রয়োজনের মুহূর্তে গচ্ছিত অর্থ একবারে তুলে নিতে চাইলে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের পক্ষে তা চাওয়ামাত্র পরিশোধ করা সম্ভব হবে কিনা, সে বিষয়ে সন্দিহান খাতসংশ্লিষ্টরা।

বিপিসির সর্বশেষ নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, গত বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোয় ১০ হাজার ৭৪০ কোটি টাকা দীর্ঘমেয়াদি আমানত হিসেবে জমা রেখেছে বিপিসি, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ১৩ হাজার ৫৪৬ কোটি টাকা। ব্যাংকগুলোর বাইরে রাষ্ট্রায়ত্ত বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশের (আইসিবি) কাছে গত জুন শেষে বিপিসির দীর্ঘমেয়াদি আমানত ছিল ৩৮২ কোটি ৯৪ লাখ টাকা। বেসরকারি ১২ ব্যাংকে এ সময় স্বল্পমেয়াদি আমানত ছিল ১ হাজার ৮৩১ কোটি টাকার। এর আগে ২০২১ সালের জুন শেষে ২১টি বেসরকারি ব্যাংকে বিপিসির গচ্ছিত স্বল্পমেয়াদি আমানতের পরিমাণ ছিল ২ হাজার ৭৯৭ কোটি টাকা।

এর বাইরেও জ্বালানি তেল বিক্রি বাবদ বিভিন্ন ব্যাংকে বিপিসির হিসাবে ২০২২ সালের জুন শেষে ১৪ হাজার ৫০৮ কোটি টাকা নগদ ছিল। আগের বছরে এ অর্থের পরিমাণ ছিল ১৫ হাজার ৮২২ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে ২০২২ সালের ৩০ জুন বিপিসির বিভিন্ন ব্যাংক হিসাবে জমা থাকা অর্থের পরিমাণ ছিল ২৭ হাজার ৪৬২ কোটি টাকা। আগের বছরের একই সময়ে এর পরিমাণ ছিল ৩২ হাজার ১৬৪ কোটি টাকা।

দেশের ব্যাংক খাতে চলছে তীব্র তারল্য সংকট। এ সংকটের কারণে আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারের (কলমানি) সুদহার মেয়াদি আমানতের সুদহারকেও ছাড়িয়ে গেছে। নিকট অতীতে কলমানি বাজারে অর্থের এমন তেজ দেখা যায়নি। মূলত ব্যাংকগুলোয় নগদ অর্থ সংকটের কারণেই কলমানি বাজারের সুদহার এ উচ্চতায় উঠেছে। তারল্য সংকট কাটাতে কোনো কোনো ব্যাংক এখন ৮ শতাংশ সুদে হলেও গ্রাহকের কাছ থেকে আমানত সংগ্রহে মরিয়া হয়ে নেমেছে।

ব্যাংক খাতে তারল্য সংকটের পেছনে বিপিসির এলসির মূল্য পরিশোধও বড় একটি ভূমিকা রেখেছে বলে মনে করছেন ব্যাংক কর্মকর্তারা। তাদের ভাষ্যমতে, জ্বালানি তেল আমদানির জন্য বিপিসি যেসব এলসি খুলছে, সেগুলোর দায় মেটানোর জন্য ব্যাংকগুলোকে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ডলার কিনতে হচ্ছে। এতে ব্যাংকের আমানতের অর্থ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাবে চলে যাচ্ছে। বিপিসি প্রতি মাসে হাজার হাজার কোটি টাকার এলসি খোলে। এসব এলসির দায় পরিশোধ করতে গিয়ে ব্যাংক খাত থেকে সমপরিমাণ অর্থ কমে যাচ্ছে। ব্যাংক খাতে তারল্য সংকট তৈরি হওয়ার পেছনে বিপিসির আমানত কমে যাওয়ার বড় ভূমিকা আছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে রাষ্ট্রায়ত্ত একটি ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহী বণিক বার্তাকে বলেন, ‘জ্বালানি তেল আমদানির জন্য এক ধরনের জামানত হিসেবে বিপিসি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোয় বড় অংকের অর্থ আমানত রাখে। তবে গত এক বছরে প্রতিষ্ঠানটির আমানত অনেক কমেছে। বিপিসি দেশের সবচেয়ে ধনী প্রতিষ্ঠান। এ কারণে প্রতিষ্ঠানটির আমানত কমার প্রভাব পুরো ব্যাংক খাতের ওপর পড়েছে। শুধু বিপিসি নয়, রাষ্ট্রায়ত্ত অন্যান্য প্রতিষ্ঠানেরও আমানত কমছে। বিপিসিসহ সরকারি বড় প্রতিষ্ঠানগুলো যদি বিশেষ প্রয়োজনে আরো বেশি অর্থ ব্যয় করতে চায়, তাহলে গোটা ব্যাংক খাতের তারল্য পরিস্থিতি আরো নাজুক হবে।’

তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক, আইসিবি ও বেসরকারি ব্যাংকগুলোয় থাকা বিপিসির মেয়াদি আমানত ও নগদ অর্থের পরিমাণ এক বছরের ব্যবধানে সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকারও বেশি কমেছে। জ্বালানি তেল আমদানির জন্য রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী, জনতা, অগ্রণী ও রূপালী ব্যাংকে এলসি খোলে বিপিসি। এ কারণে চারটি ব্যাংকেই দীর্ঘমেয়াদি আমানত জমা রেখেছে প্রতিষ্ঠানটি। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৪ হাজার ২০৮ কোটি টাকার মেয়াদি আমানত জমা আছে জনতা ব্যাংকে। রূপালী ব্যাংকে ২ হাজার ৯৩৪ কোটি টাকার আমানত রাখা হয়েছে। আর রাষ্ট্রায়ত্ত অগ্রণী ব্যাংকে ২ হাজার ৫৫৭ কোটি ও সোনালী ব্যাংকে ১ হাজার ৩৯ কোটি ৮২ লাখ টাকার আমানত জমা রেখেছে বিপিসি। আমানতের বাইরে রূপালী ব্যাংকে ৩ হাজার ৪৮৩ কোটি, জনতা ব্যাংকে ২ হাজার ৬৮৬ কোটি, অগ্রণী ব্যাংকে ২ হাজার ৪১৬ কোটি ও সোনালী ব্যাংকে ২ হাজার ৪১০ কোটি টাকার নগদ অর্থ জমা রেখেছে বিপিসি। এ চার ব্যাংকে বিপিসির গচ্ছিত মোট নগদ অর্থের পরিমাণ ২০২২ সালের জুন শেষে ছিল ১০ হাজার ৯৯৬ কোটি টাকা। এছাড়া ২৮টি বেসরকারি ব্যাংকে গচ্ছিত ছিল ৪ হাজার ৮২৬ কোটি টাকার নগদ অর্থ।

যদিও গত এক বছরে বৈশ্বিক জ্বালানি সংকট ও মূল্যস্ফীতির জেরে সংস্থাটির অর্থে টান পড়েছে। বড় অংকের লোকসানও গুনতে হয়েছে প্রতিষ্ঠানটিকে। সামনের দিনগুলোয় বৈশ্বিক জ্বালানি তেলের বাজারে অস্থিরতা আরো বাড়লে বিপিসির কাছে থাকা অর্থের পরিমাণ আরো সংকুচিত হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। বিপিসি টাকা নিয়ে গেলে দেশের অনেক ব্যাংক বিপদে পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য পর্যালোচনায় যায়, গত এক বছরে ব্যাংক খাতে আমানতের তুলনায় ঋণের প্রবৃদ্ধি দ্বিগুণ হয়েছে। গত অক্টোবরে দেশের বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৩ দশমিক ৯১ শতাংশ। যদিও একই সময়ে আমানতের প্রবৃদ্ধি ছিল ৭ শতাংশের ঘরে। দেশের ব্যাংক খাতে এক বছরের বেশি সময় ধরে চলছে ডলার সংকট। আমদানি দায় ও সরকারি-বেসরকারি বিদেশী ঋণ পরিশোধ করার জন্য ব্যাংকগুলোর কাছে এক বছরে প্রায় ১৫ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর মাধ্যমে ব্যাংক খাত থেকে প্রায় দেড় লাখ কোটি টাকার তারল্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকে চলে যায়। পাশাপাশি কিছু ব্যাংক নিয়ে তৈরি হওয়া বিতর্কের কারণে গ্রাহক ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নেন। এসব কারণে ব্যাংক খাতের তারল্য সংকট তীব্র হয়ে উঠেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০২১ সালের অক্টোবর শেষে ব্যাংক খাতের বাইরে থাকা নগদ অর্থের পরিমাণ ছিল ২ লাখ ৫ হাজার ৮৯৫ কোটি টাকা। ২০২২ সালের অক্টোবরে ব্যাংকের বাইরে থাকা নগদ অর্থের পরিমাণ ২ লাখ ৩৬ হাজার ১১৪ কোটি টাকায় ঠেকেছে। অক্টোবরের পর গ্রাহকদের মধ্যে ব্যাংক থেকে নগদ টাকা তুলে নেয়ার প্রবণতা আরো বেড়েছে।

মুনাফার অর্থ থেকে স্বল্পমেয়াদি আমানত হিসেবে দেশের ১২টি বেসরকারি ব্যাংকে অর্থ বিনিয়োগ করেছে বিপিসি। এর মধ্যে ২০২২ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত এবি ব্যাংকে ৪২৩ কোটি, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকে ৩৬৫ কোটি, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকে ২৫৯ কোটি, ইউনিয়ন ব্যাংকে ২০৮ কোটি, ওয়ান ব্যাংকে ১১৭ কোটি, আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকে ১১৫ কোটি, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকে ১১৩ কোটি, মার্কেন্টাইল ব্যাংকে ১০৬ কোটি, এক্সিম ব্যাংকে ৭২ কোটি, মেঘনা ব্যাংকে ২১ কোটি, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকে ১০ কোটি ও স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকে ১০ কোটি টাকার স্বল্পমেয়াদি আমানত ছিল বিপিসির।

বিষয়টি অত্যন্ত সংবেদনশীল হওয়ায় বিপিসি ও ব্যাংক খাতসংশ্লিষ্টদের কেউই এ বিষয়ে সরাসরি নাম প্রকাশ করে কথা বলতে রাজি হননি। তবে এ প্রতিবেদনের অধিকাংশ বক্তব্য ও ব্যাখ্যা মূলত তাদের কাছ থেকেই পাওয়া।-বণিক বার্তা