নিত্যপণ্য, জ্বালানি আমদানিতেও ডলার সংকট

নিত্যপণ্য, জ্বালানি আমদানিতেও ডলার সংকট

করোনা-পরবর্তী বাড়তি চাহিদা এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে অনেক দিন ধরে বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে ডলারের চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম। এ কারণে অতি প্রয়োজনীয় নয় এমন পণ্য আমদানিতে নিরুৎসাহিত করে আসছিল ব্যাংকগুলো। কিন্তু রমজানের প্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্য আমদানিতেও ডলারের সংকট হচ্ছে। একাধিক বড় আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান রোজায় পণ্য সরবরাহ সংকট হতে পারে বলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছে। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের আমদানিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কিছু ডলার জোগান দিলেও ডলারের অভাবে আগের দেনা পরিশোধ করতে পারছে না কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান।

সমস্যা সমাধানে অর্থ, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন পর্যায় থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে অনুরোধ করা হচ্ছে। কিন্তু ডলার সংকটের সমাধান মিলছে না।বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, এবারের রমজানে চাহিদা মেটাতে তেল, চিনি, ছোলা, খেজুরসহ বেশি প্রয়োজনীয় সাতটি ভোগ্যপণ্য আমদানিতে প্রায় ২৫০ কোটি ডলারের দরকার হবে। ৯৭ কোটি ৪০ লাখ ডলার ব্যয়ে ৭ লাখ টন ভোজ্যতেল, ৮১ কোটি ২০ লাখ ডলার ব্যয়ে ২২ লাখ টন গম এবং ৩৮ কোটি ৫০ লাখ ডলার ব্যয়ে ৮ লাখ টন চিনি আমদানির প্রয়োজন হবে। এ ছাড়া ২ লাখ ১০ হাজার টন ছোলা আমদানিতে ১৩ কোটি ৪০ লাখ ডলার, ১ লাখ ৫৭ হাজার টন মসুর ডাল আমদানিতে ১৪ কোটি ১০ লাখ ডলার এবং ৫৯ হাজার টন খেজুর আমদানিতে ৫ কোটি ৩০ লাখ ডলার ব্যয় হবে।

রমজানে প্রয়োজনীয় পণ্যের এলসি খোলা ও নিষ্পত্তিতে ডলার সরবরাহ নিশ্চিত করার অনুরোধ জানিয়ে গত রোববার বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর বরাবর আবারও চিঠি দিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।এর আগে গত ১৪ ডিসেম্বর গভর্নরকে একই অনুরোধ জানিয়ে চিঠি দেয় মন্ত্রণালয়। গত ১২ ডিসেম্বর এফবিসিসিআই সভাপতির নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল গভর্নরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে রোজার আগে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে ডলার সংস্থানের দাবি জানান।জানা গেছে, দেশের অন্যতম ভোগ্যপণ্য সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান সিটি গ্রুপ চিনি, ছোলা, তেলসহ সাত ধরনের পণ্য আমদানির চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছে। গ্রুপটি দেশের ২৮টি ব্যাংকে যোগাযোগ করে ডলার সংকটে এলসি খুলতে পারেনি। সিটি গ্রুপ মোট ৩৮ কোটি ৫২ লাখ ডলার সমপরিমাণ ৪ হাজার কোটি টাকার বেশি পণ্যের জন্য এলসি খুলতে না পেরে সম্প্রতি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দ্বারস্থ হয়। সিটি গ্রুপের পরিচালক (অর্থ) বিশ্বজিৎ সাহা সমকালকে জানান, ডলার সংকটে তাঁরা প্রয়োজনীয় এলসি খুলতে পারছেন না। নিজেদের সমস্যার কথা জানিয়ে তাঁরা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে চিঠি লিখেছেন। কিন্তু সমাধান পাননি।

এদিকে দেশবন্ধু গ্রুপ সম্প্রতি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে চিঠি লিখে জানিয়েছে, তারা গত চার মাস থেকে বিভিন্ন ব্যাংকে ঘুরেও চিনি আমদানির এলসি খুলতে পারেনি। চিনি আমদানি করতে না পারলে রমজানে দ্রব্য সরবরাহ স্বাভাবিক রাখা যাবে না।দেশবন্ধু গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক গোলাম রহমান সমকালকে বলেন, চিনি আমদানির জন্য ডলার সংস্থানে বাংলাদেশ ব্যাংক, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়সহ সরকারের সংশ্নিষ্টদের তাঁরা অনুরোধ করেছেন। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ও রমজান সামনে রেখে চিনিসহ কয়েকটি নিত্যপণ্য আমদানিতে সহজে এলসি খোলার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংককে বলেছিল। কিন্তু কে শোনে কার কথা। ব্যাংক এলসি নিচ্ছেই না। আমদানি না হলে চিনি বাজারে আসবে কোথা থেকে। তিনি দ্রুত ডলার সংস্থানের দাবি জানান।

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেন, চলমান বিশ্ব পরিস্থিতিতে আমদানিনির্ভর পণ্যের জন্য এলসি খোলার ক্ষেত্রে কিছু সমস্যা হচ্ছে। রমজানে প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানিতে ডলার সহায়তার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংককে বলা হয়েছে। সহায়তা পেলে সমস্যা থাকবে না। ডলারের কিছুটা সংকট রয়েছে, তা এখন সবাই জানে। বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দিয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় কাজ করছে।বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক সমকালকে বলেন, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি সহজ করতে ব্যাংকগুলোর জন্য ইতোমধ্যে দুটি সার্কুলার জারি করা হয়েছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের চিঠির বিষয়ে সংশ্নিষ্ট বিভাগ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে সিদ্ধান্ত নেবে।রোজায় নিত্যপণ্য সরবরাহে সহযোগিতা করতে গত ডিসেম্বরে দুটি সার্কুলার জারি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। একটি সার্কুলারে তেল, চিনি, ছোলা, খেজুর, ডাল, মটর, পেঁয়াজ ও মসলা ৯০ দিনের বাকিতে আমদানির সুযোগের কথা বলা হয়। অপর এক নির্দেশনায় এসব পণ্য আমদানিতে এলসি মার্জিন নূ্যনতম পর্যায়ে রাখতে বলা হয়। তবে ভোগ্যপণ্য আমদানি ও সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, এই মুহূর্তে ডলারের সংস্থান দরকার। ব্যাংকগুলো ডলার দিতে না পারলে এসব নির্দেশনা কাজে আসবে না।

বিদ্যুৎ খাতেও একই সংকট :সরকারের সার, বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খাদ্য আমদানিতে সরাসরি কিছু ডলার বিক্রি করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তবে তা চাহিদার তুলনায় পর্যাপ্ত নয়। জানা গেছে, অর্থ মন্ত্রণালয়ের গ্যারান্টির বিপরীতে নেওয়া বিদ্যুৎ খাতের বিদেশি ঋণেও ডলার সংকট রয়েছে। কিছু কোম্পানির বিদেশি ঋণের কিস্তি পরিশোধে ব্যর্থ হচ্ছে ব্যাংকগুলো। জ্বালানি তেল আমদানিও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।

সম্প্রতি বিদ্যুৎ বিভাগে পাঠানো বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের এক চিঠিতে বলা হয়, বড়পুকুরিয়া বিদ্যুৎকেন্দ্রের সম্প্রসারণ এবং ঘোড়াশাল তৃতীয় ইউনিটের নির্মাণে ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড কমার্শিয়াল ব্যাংক চায়নার (আইসিবিসি) কাছ থেকে ৪৪ কোটি ৫৫ লাখ ডলার ঋণ নেয় পিডিবি। ২০টি কিস্তির মধ্যে বড়পুকুরিয়ার ৯টি ও ঘোড়াশালের ৮টি কিস্তি পরিশোধ করা হয়েছে। বড়পুকুরিয়ার দশম কিস্তির জন্য ১৫ দশমিক ২৬ মিলিয়ন ডলার সোনালী ব্যাংকের শোধ করার কথা থাকলেও দু'বার ব্যর্থ হয়েছে। সভরেন গ্যারান্টি দেওয়ায় এ ঋণ শোধে ব্যর্থ হলে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে বলে চিঠিতে উল্লেখ করা হয়।ডলার সংকটে পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের কয়লার বিল পরিশোধে হিমশিম খাচ্ছে বাংলাদেশ-চায়না পাওয়ার কোম্পানি বিসিপিসিএল। গত ২২ ডিসেম্বর পিডিবিকে লেখা এক চিঠিতে কোম্পানিটি জানায়, এই বিদ্যুৎকেন্দ্রের কয়লা সরবরাহ করে চীনের সিএমসি। গত ডিসেম্বর পর্যন্ত সিএমসির বকেয়া প্রায় ১৬ কোটি ডলার। কয়লা আমদানির ধারাবাহিকতা রাখতে গত নভেম্বর পর্যন্ত বকেয়া প্রায় ১২ কোটি ডলার দ্রুত পরিশোধ করা প্রয়োজন। এ অর্থ পরিশোধ না করলে কয়লা আমদানিতে বিঘ্ন ঘটতে পারে।

ডলার সংকটে বিসিপিসিএলের কয়লা খালাসেও সমস্যা হচ্ছে। গত ১৮ ডিসেম্বর সোনালী ব্যাংকে লেখা এক চিঠিতে কোম্পানিটি জানায়, চারটি জাহাজে কয়লা এসেছে। চুক্তি অনুসারে খালাসের আগে বিলের ৯০ শতাংশ পরিশোধ করতে হয়। ভাড়ার অগ্রিম বাবদ ৪০ লাখ ডলার পরিশোধ করতে সোনালী ব্যাংকের হোটেল কন্টিনেন্টাল শাখাকে অনুরোধ করা হলেও ডলার সংকটে তারা তা পরিশোধ করেনি। খালাসে বিলম্ব হলে চার জাহাজে প্রতিদিন ৬০ হাজার ডলার ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।জানতে চাইলে বিসিপিসিএল পরিচালক এ এম খোরশেদুল আলম বলেন, তিনটি জাহাজের ভাড়া পরিশোধ সম্ভব হয়েছে। আরেকটির পরিশোধের বিষয়ে চেষ্টা চলছে।

পর্যাপ্ত টাকা থাকলেও ডলারের অভাবে জ্বালানি তেল আমদানির সব বিল পরিশোধ করতে পারছে না বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)। ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ট্রেড ফাইন্যান্স করপোরেশন (আইটিএফসি) থেকে ঋণ নিয়ে আমদানির দেনা শোধ করার ক্ষেত্রে সংকট তৈরি হয়েছে। ঋণ পরিশোধে মেয়াদ বাড়ানোর অনুরোধ জানালেও তাতে রাজি হয়নি আইটিএফসি। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের সঞ্চালন লাইন স্থাপনে যন্ত্রপাতি আমদানির এলসি খুলতেও সমস্যা হচ্ছে। যথাসময়ে ৫২ কোটি ৪২ ডলারের সমপরিমাণ প্রায় ৫ হাজার ৩৪৭ কোটি টাকার এলসি খুলতে না পেরে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে গড়ে ওঠা দেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের সঞ্চালন লাইন নির্মাণে জটিলতা দেখা দিয়েছে। এলসি খোলার বিষয়ে প্রয়োজনীয় সহায়তা চেয়ে বিদ্যুৎ বিভাগের মাধ্যমে সম্প্রতি অর্থ মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছে পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ।

বিদেশি ঋণে আগ্রহ কম আমদানিকারকদের :সুযোগ থাকলেও আপাতত বিদেশি ঋণে এলসি খুলতে ব্যবসায়ীদের আগ্রহ কম। এর কারণ প্রথমত, বিনিময় হারজনিত লোকসানের ঝুঁকি। আগামীতে ডলারের দর কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে নিশ্চিত করে তা কেউ বলতে পারছে না। দ্বিতীয়ত, বিদেশি ঋণের সুদহার অনেক বেড়েছে। বর্তমানে বিদেশ থেকে ঋণ নিয়ে পণ্য আমদানিতে ৮ শতাংশের বেশি সুদ দিতে হচ্ছে। এক বছর আগেও যা ৪ থেকে ৫ শতাংশের মতো ছিল। ফলে উচ্চ সুদে ঋণ নেওয়াকেও স্বস্তিদায়ক মনে করছেন না অনেকে। এর বাইরে বৈশ্বিক পরিস্থিতির কারণে অনেক বিদেশি ব্যাংক ডেফার্ড পেমেন্ট বা দেরিতে পরিশোধের শর্তে এলসি নিতে চাইছে না।

চাপের মুখে রিজার্ভ :বিলাসবহুল ও কম প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি কমাতে শতভাগ পর্যন্ত এলসি মার্জিন নির্ধারণ করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আবার অনেক ধরনের পণ্য আমদানিতে শুল্ক্ক বাড়ানো হয়েছে। সরকারি প্রকল্পের কাজ স্থগিতসহ বিভিন্ন উপায়ে ব্যয় সাশ্রয়ী নীতি নেওয়া হয়েছে। এসব উদ্যোগের পরও চলতি অর্থবছরের নভেম্বর পর্যন্ত সামগ্রিক লেনদেন ভারসাম্যে ৬ দশমিক ৩৮ বিলিয়ন ডলারের ঘাটতি তৈরি হয়েছে। বাণিজ্য ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১১ দশমিক ৭৯ বিলিয়ন ডলারে। এ অবস্থায় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আরও কমে সোমবার ৩২ দশমিক ৫১ বিলিয়ন ডলারে নেমেছে।