আইএমএফের ঋণের শর্ত পূরণে বিশেষ তদারকি

আইএমএফের ঋণের শর্ত পূরণে বিশেষ তদারকি

অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে ৪৫০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ চায় বাংলাদেশ। আইএমএফ ঋণ দিতে রাজি। এ জন্য অর্থনীতির সংস্কারে কিছু শর্ত পালন করতে হবে। আইএমএফের শর্ত পূরণ যাতে ঠিকঠাক হয়, তার জন্য বিশেষ তদারকির ব্যবস্থা করা হয়েছে। এ উদ্দেশ্যে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও দপ্তরের সমন্বয়ে ২২ সদস্যের একটি উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গঠন করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়।

এদিকে ঋণ নিয়ে চূড়ান্ত আলোচনা করতে আইএমএফের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) অ্যান্তইনেত মনসিও সায়েহ আসছেন ঢাকায়। আজ শনিবার তাঁর ঢাকায় পৌঁছানোর কথা। সফরকালে অ্যান্তইনেত মনসিও সায়েহ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার, অর্থ বিভাগের সিনিয়র সচিব ফাতিমা ইয়াসমিনের সঙ্গে বৈঠক করবেন। আইএমএফের ডিএমডি ১৮ জানুয়ারি যাবেন পদ্মা সেতু দেখতে এবং ওই দিনই তিনি ঢাকা ছাড়বেন। এদিকে রাজস্ব বাড়ানোসহ বৈদেশিক মুদ্রা বাজার ব্যবস্থাপনার পাশাপাশি আর্থিক খাত পরিচালনায় নীতিমালা এবং তদারকিতে দক্ষ জনবল গড়ে তুলতে সহায়তার আগ্রহ জানিয়ে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালকে চিঠি লিখেছে আইএমএফ কর্তৃপক্ষ।

অর্থ বিভাগের একজন অতিরিক্ত সচিবকে সমন্বয় কমিটির সভাপতি এবং একই বিভাগের একজন উপসচিবকে এর সদস্য সচিব করা হয়েছে। কমিটিতে অর্থ বিভাগ ছাড়া পরিকল্পনা কমিশন, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ, অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ, অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তর, পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগ, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো, বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়, বিদ্যুৎ বিভাগ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগ, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক এবং পিপিপি কর্তৃপক্ষের প্রতিনিধি রাখা হয়েছে।
কমিটির কার্যপরিধিতে উল্লেখ করা হয়েছে, তারা আইএমএফের ঋণ কর্মসূচির আওতায় নীতি কার্যক্রম বাস্তবায়ন পর্যালোচনা করবে। কোনো নীতি কার্যক্রম বাস্তবায়নে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হলে তা সঙ্গে সঙ্গে অর্থ মন্ত্রণালয়কে জানাবে। কমিটি প্রতি দুই মাসে একটি সভার আয়োজন করবে।

অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ঋণ দেওয়ার জন্য প্রাথমিকভাবে মোটাদাগে তিন ধরনের শর্ত দেওয়া হয়েছে। প্রথম ধরন গুণগত মান উন্নয়ন-সংক্রান্ত শর্ত (কিউপিসি), দ্বিতীয় ধরন অবকাঠামোগত মান উন্নয়ন-সংক্রান্ত শর্ত (এসপিসি) ও তৃতীয়টি সাধারণ প্রতিশ্রুতি। এর মধ্যে কিউপিসি হচ্ছে বাধ্যতামূলক শর্ত। আইএমএফ বলছে, বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের হিসাব পদ্ধতি ঠিক নেই। এটি সংশোধনের কথা বলা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক ইতোমধ্যে এটি ঠিক করার কাজে হাত দিয়েছে। সরকারের বাজেট ঘাটতি একটি নির্দিষ্ট হারের বেশি যেতে পারবে না- এমন শর্তও দিয়েছে। যখনই কিস্তি দেওয়ার সময় হবে, আইএমএফ এগুলো মিলিয়ে দেখবে। এসপিসির মধ্যে রয়েছে জ্বালানির দাম নির্ধারণে আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী পদ্ধতি কার্যকর, নতুন আয়কর আইন কার্যকর, ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন করা, আদায় অযোগ্য খেলাপি ঋণ বিষয়ে আলাদা কোম্পানি গঠন করা, আর্থিক খাতে তদারকি বাড়ানো, করছাড়ের ওপর বিশদ নিরীক্ষা, বাজেটের নির্দিষ্ট অংশ সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির জন্য রাখা। অন্যান্য শর্তের মধ্যে রয়েছে ভর্তুকি কমানো, বাজেট থেকে সঞ্চয়পত্রকে আলাদা করা, ব্যাংক ঋণের সুদহারে ৯ শতাংশের সীমা তুলে দেওয়া, নগদ ও ঋণ ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা আনা, ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ কমানো ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা ইত্যাদি।

এ বিষয়ে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম সমকালকে বলেন, আইএমএফ যে সংস্কার বা শর্তের উল্লেখ করেছে, সেগুলো সরকারের অনেক আগেই বাস্তবায়ন করা উচিত ছিল। বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও দপ্তরের সমন্বয়ে গঠিত কমিটির তদারকিতে সংস্কার কার্যক্রম ত্বরান্বিত হবে বলে তিনি মনে করেন। তাঁর মতে, দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ক্রমান্বয়ে কমছে। এ অবস্থায় আইএমএফসহ অন্যান্য বহুজাতিক সংস্থা থেকে সহযোগিতা পাওয়া গেলে তা অর্থনীতিতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আইএমএফ ৪২ মাসে সাত কিস্তিতে ৪৫০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ দেবে বাংলাদেশকে। ৪৫০ কোটি ডলার ঋণ অনুমোদনের প্রস্তাব আইএমএফের পর্ষদে উঠবে আগামী ৩০ জানুয়ারি। ঋণের প্রথম কিস্তির ৩৬ কোটি ডলার বাংলাদেশ পাবে আগামী মার্চে। পরের প্রতিটি কিস্তি ছাড়ের আগে শর্ত বাস্তবায়নের অগ্রগতি দেখবে আইএমএফ।

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর সমকালকে বলেন, দীর্ঘ দিন থেকে দেশের অর্থনীতিবিদরা যেসব সংস্কারের কথা বলে আসছিলেন আইএমএফও সে বিষয়গুলোই শর্ত হিসেবে দিচ্ছে। তবে কঠিন শর্ত কিছু থাকছে কিনা পর্ষদ বৈঠক হওয়ার পরই বোঝা যাবে। তিনি বলেন, একটি বিষয় মাথায় রাখতে হবে যে, প্রতি কিস্তির আগেই আলাদা করে পর্যালোচনা করবে আইএমএফ। শর্ত পূরণ না হলে কিস্তি আটকে যাওয়ার উদাহরণ রয়েছে। তাই এক্ষেত্রে খুব সতর্ক থাকার পরামর্শ দেন তিনি।

অর্থমন্ত্রীকে চিঠি: আর্থিক খাত পরিচালনায় দক্ষ জনবল গড়ে তোলার আগ্রহের কথা জানিয়ে গত ২৩ ডিসেম্বর অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালকে চিঠি দিয়েছে আইএমএফ কর্তৃপক্ষ। চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর জন্য আগামী ফেব্রুয়ারি থেকে পাঁচ বছর মেয়াদে প্রশিক্ষণ ও কারিগরি সহায়তা কার্যক্রম হাতে নিয়েছে সংস্থাটি। এ কার্যক্রমের আওতায় সরকারি আর্থিক ব্যবস্থাপনা, রাজস্ব বাড়ানোর পাশাপাশি মুদ্রানীতি ও বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবস্থাপনায় দক্ষ কর্মী গড়ে তুলতে প্রশিক্ষণ ও কারিগরি সহায়তা দেওয়া হবে। একইসঙ্গে আর্থিক খাত পরিচালনা এবং তদারকি, সামষ্টিক অর্থনীতি এবং পরিসংখ্যানগত দিকনির্দেশনাও দেওয়া হবে। এর আগে রাজস্ব খাতে সংস্কার নিয়ে কাজ করতে আগ্রহ প্রকাশ করে গত নভেম্বরে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিমকে চিঠি দেয় আইএমএফ। এতে বলা হয়, এ খাতের সংস্কারে আইএমএফ এনবিআরকে লিখিত সুপারিশ জানাবে।-সমকাল