পথশিশুদের নামে লাখ লাখ টাকা তুলে আত্মসাৎ

পথশিশুদের নামে লাখ লাখ টাকা তুলে আত্মসাৎ

একসময় ঢাকা শহরে সবজি ও চা পাতা বিক্রি করে সংসার চলত ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ইমন চৌধুরীর। পরে প্রতারণার উদ্দেশ্যে গড়ে তোলেন ‘ফিউচার বাংলা সমাজ কল্যাণ সংস্থা’।

২০১৭ সালে সংগঠনটি বাদ দিয়ে গঠন করেন ‘প্রথম অক্ষর ফাউন্ডেশন’ নামের আরেকটি সংগঠন। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের পথশিশুদের সহায়তা করার নামে সংগঠটি বিপুল পরিমাণ অর্থ তোলে।

শুধু রাজধানীতেই দৈনিক ৫০-৬০টি বক্স নিয়ে ৬০০ স্বেচ্ছাসেবক দিয়ে লাখ লাখ টাকা তোলা হয়। কিন্তু পথশিশুদের জন্য কিছুই করে না ফাউন্ডেশন।

সাধারণ মানুষের আবেগকে কাজে লাগিয়ে তোলা অর্থের সামান্য পরিমাণ স্বেচ্ছাসেবকদের দেয়া হতো। বাকি অর্থ আত্মসাৎ করতেন ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ইমন।

শুধু তাই নয়, সংগঠনের আড়ালে চলত তার মাদক ব্যবসাও। নানা প্রলোভনে নারী স্বেচ্ছাসেবকদের ধর্ষণ করতেন তিনি। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

সূত্র জানায়, ডিবি উত্তরা বিভাগের বিমানবন্দর জোনাল টিমের অভিযানে মাদকসহ গ্রেফতার হন সংগঠনটির চেয়ারম্যান ইমন ও মহাসচিব নুসরাত জাহান লিন্ডা।

শুক্রবার রাতে রাজধানীর খিলগাঁও রহিম টাওয়ারের ৩য় তলার অফিস থেকে তিন হাজার ৪০০ পিস ইয়াবাসহ গ্রেফতারের পর খিলগাঁও থানায় মাদক আইনে মামলা করেছে ডিবি।

শনিবার তাদের আদালতে পাঠালে একদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত। দুজনই এখন ডিবি হেফাজতে আছেন। তাদের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, প্রতারণা ও ধর্ষণসহ বিভিন্ন অভিযোগে কয়েকটি মামলার প্রস্তুতি চলছে।

ডিবি ও সংগঠনে কাজ করা স্বেচ্ছাসেবকরা জানিয়েছেন, নিয়োগ দেওয়ার সময় বলা হতো- কালেকশনের অর্ধেক সংগঠন নেবে আর অর্ধেক পাবে স্বেচ্ছাসেবকরা। কিন্তু বাস্তবে তাদের দেওয়া হতো চার ভাগের এক ভাগ। মাঝেমধ্যে লোক দেখানো কয়েকটি স্থানে পথশিশুদের মাঝে খাবার বিতরণ করতেন। তাও বিভিন্ন রেস্টুরেন্ট ও পার্টি সেন্টারের উচ্ছিষ্টাংশ। ইমন নিজেকে চিকিৎসক পরিচয় দিলেও তার কোনো সনদ নেই। স্বেচ্ছাসেবকরা টাকা তোলার সময় বিভিন্ন নামি-দামি কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র বলে পরিচয় দিলেও প্রকৃতপক্ষে তারা ছাত্র নন।

প্রথম অক্ষর ফাউন্ডেশনে সাত বছর কাজ করে আসছিলেন লাইজু আক্তার। তিনি বলেন, স্বামী মারা যাওয়ায় তার সংসার চালাতে কষ্ট হতো। একদিন একটি ফেসবুক পেজে বিজ্ঞাপন দেখতে পান। সেখানে লেখা ছিল- ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের জন্য কিছু সংখ্যক ছেলেমেয়ে

নেয়া হবে। এরপর তিনি পেজে উল্লেখ করা ঠিকানায় গেলে ১৫ হাজার টাকা বেতনে চাকরির আশ্বাস দেওয়া হয়। প্রথমে লিন্ডা মোটিভেশনাল মিটিং করতেন, সবাইকে উৎসাহ দিতেন। বলতেন, এটি একটি সামাজিক কাজ। কিন্তু কাজ করতে গিয়ে দেখি পথশিশুদের নামে তোলা অর্থের পুরোটাই আত্মসাৎ করতেন ইমন। এর ভাগ পেতেন লিন্ডা। স্বেচ্ছাসেবকদের মধ্যে ইমনের পছন্দের কিছু লোক ইয়াবা সংগ্রহ করতেন। ইয়াবা সেবন করে রাত-দিন কাজ করতেন।

ডিবি জানায়, ইমন স্বেচ্ছাসেবক হিসাবে মেয়েদের বেশি নিয়োগ দিতেন। তার প্রতারণামূলক কর্মকাণ্ড দেখে অনেকে চলে যেতে চাইলেও সম্ভব হতো না। ইমন সুবিধা দেয়ার কথা বলে তাদের সঙ্গে অনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তুলতেন। ভিডিও করে এর প্রমাণ রেখে দিতেন।

ভয় দেখিয়ে বলতেন, বিষয়টি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে জানানো হলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল করে দেওয়া হবে। আর ছেলে স্বেচ্ছাসেবকদের মাদক দিয়ে ফাঁসিয়ে দেয়ার হুমকি দিতেন। তাই কেউ চাইলেও মুখ খুলতে পারতেন না। ইমনের ডেরা থেকে বেরিয়ে যেতে পারতেন না। ইমনের ইউটিউব চ্যানেলও রয়েছে। মেয়ে স্বেচ্ছাসেবকদের ওই চ্যানেলে রিপোর্টার পরিচয় দিয়ে বিভিন্ন স্থানে পাঠাতেন।

ডিবি উত্তরা বিভাগের বিমানবন্দর জোনাল টিমের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (এডিসি) কায়সার রিজভী কোরায়েশী বলেন, দীর্ঘ সাত বছর ধরে এমনটি করছিলেন ইমন।

গ্রেফতার দুজন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা এলাকা থেকে ইয়াবা, ফেনসিডিল এনে রাজধানীতে বিক্রি করতেন। সুনির্দিষ্ট অভিযোগে তাদের গ্রেফতার করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে আরও যেসব মামলা প্রক্রিয়াধীন আছে সেসব মামলাতেও রিমান্ড চাওয়া হবে।

এমজে/