সরকারের সমালোচনা নয়, সারাক্ষণ প্রশংসা করতে হবে: আনু মুহাম্মদ

সরকারের সমালোচনা নয়, সারাক্ষণ প্রশংসা করতে হবে: আনু মুহাম্মদ

আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকারের কড়া সমালোচনা করে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেছেন, এই সরকারের অবস্থানটা হচ্ছে, কোনো ত্রুটি-বিচ্যুতির সমালোচনা করা যাবে না, সারাক্ষণ প্রশংসা ও বন্দনা করতে হবে। এখন আমরা যে শাসনের মধ্যে আছি, সেটিও জেনারেল শাসনের মতোই। সামরিক শাসন হলেও এখনকার চেয়ে আলাদা কিছু হতো না।

আজ শুক্রবার বিকেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র (টিএসসি) মিলনায়তনে আয়োজিত এক আলোচনা সভায় অংশ নিয়ে আনু মুহাম্মদ এসব কথা বলেন। সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট (বাসদ) ‘স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা’ শীর্ষক এই আলোচনা সভার আয়োজন করে।

আলোচনায় অংশ নিয়ে আনু মুহাম্মদ বলেন, বাংলাদেশের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে আমরা বিভিন্ন ধরনের কর্মসূচি দেখতে পাচ্ছি। এর মধ্যে উচ্ছ্বাস অনেক বেশি, দেশের অর্জনের ব্যাপারে পর্যালোচনা কম। বর্তমান সরকার কাজ করছে এক রকম, বলছে তার বিপরীত। বর্তমান সরকারের অবস্থানটা হচ্ছে, কোনো ত্রুটি-বিচ্যুতির সমালোচনা করা যাবে না, সারাক্ষণ প্রশংসা ও বন্দনা করতে হবে। আমাদের অনেক বুদ্ধিজীবীও ওভাবেই অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছেন। মনে হয় যে আমাদের লেখক-শিল্পী-বুদ্ধিজীবীদের একটা বড় অংশকে হীরক রাজার দেশের যন্তর-মন্তর ঘর থেকে বের করা হয়েছে৷ একই মুখস্থ বন্দনা ছাড়া তাঁদের আর কোনো কথাবার্তা নেই।

রাতের বেলা সসম্মান দেশ থেকে পালালেন

অশালীন মন্তব্যের পর পদত্যাগে বাধ্য হওয়া প্রতিমন্ত্রী মুরাদ হাসানকে বিদেশে ‘পালিয়ে যেতে’ দেওয়ার সমালোচনা করেন আনু মুহাম্মদ। মুরাদের নাম উল্লেখ না করেই তিনি বলেন, মন্ত্রিসভার একজন সদস্য, যিনি যৌনসন্ত্রাস-সহিংসতার একেবারে মূর্ত রূপ, তিনি সরকারের অনুমতি পেয়ে সবার চোখের সামনে দিয়ে রাতের বেলা নিরাপদে ও সসম্মান দেশ থেকে পালালেন। ফেসবুকে সরকার সম্পর্কে সামান্য সমালোচনা করলে লেখক-শিল্পী-বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে, জেলে যেতে হয়েছে। অন্যদিকে ওই লোক (মুরাদ হাসান) ভয়ংকর রকম সন্ত্রাসী কথাবার্তা বলে, বহুজনের জীবন অতীষ্ঠ করেও মহানন্দে পার পেয়ে চলে গেলেন। মৃত্যুদণ্ডের আসামি মাফ পেয়ে যাচ্ছে, সাংবাদিককে পিটিয়ে আমলা রাষ্ট্রপতির ক্ষমা পাচ্ছে—এটিই হচ্ছে এখনকার শাসনব্যবস্থা। এখানে মোহমুক্ত পর্যালোচনা সম্ভব নয়। দায়িত্বশীল সরকার থাকলে সে-ই একে উৎসাহিত করত।

স্বাস্থ্য খাতে নৈরাজ্য ও শিক্ষা খাতে বাণিজ্য

দেশের ৫০ ভাগ লোক প্রকৃত অর্থেই শিক্ষিত হয়েছেন, এমন কথা স্বাধীনতার ৫০ বছরে এসেও নিশ্চিতভাবে বলা যাচ্ছে না বলে মন্তব্য করেন আনু মুহাম্মদ। তিনি বলেন, স্বাধীনতার ৫০ বছরে আমরা স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে দুটি জিনিস পাই। একটি নৈরাজ্য, অন্যটি বাণিজ্য। আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মধ্যে বৈষম্যহীন শিক্ষার প্রতিশ্রুতি থাকলেও গত পাঁচ দশকে শিক্ষায় বৈষম্য বেড়েছে। সরকার শিক্ষাকে ব্যবসায়ীদের হাতে ছেড়ে দিয়েছে। বাংলাদেশের মতো এমন দেশ পৃথিবীতে খুব কম পাওয়া যাবে, যেখানে শিক্ষার মধ্যে এত ভয়ংকর রকম বৈষম্য, এত ব্যাপক বাণিজ্যিক তৎপরতা। গড় আয়ের তুলনায় এত ব্যয়বহুল শিক্ষা, চিকিৎসা, পরিবহনও পৃথিবীর খুব কম দেশে পাওয়া যাবে। এরপরও সরকারের কী করে উচ্ছ্বাস আসে? পুরো উল্টো যাত্রা করে বলা হচ্ছে যে আমরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন করছি।

রাষ্ট্রপতির দুটিই প্রধান কাজ

সরকারের কড়া সমালোচনা করে আনু মুহাম্মদ আরও বলেন, এখন আমরা যে শাসনের মধ্যে আছি, সেটিও জেনারেল শাসনের মতোই৷ সামরিক শাসন হলেও এখনকার চেয়ে আলাদা কিছু হতো না। উৎপাদনশীল জ্ঞানজগতের বিকাশের যতটুকু সুযোগ পুঁজিবাদের মধ্যেও থাকে, সেটা থেকেও সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে একটা লুণ্ঠনজীবী বুর্জোয়াদের দ্বারা পরিচালিত পুঁজিবাদী ব্যবস্থা বাংলাদেশে চলছে। এদের কাছে শিক্ষা-চিকিৎসার কোনো গুরুত্ব নেই। এরপরও উচ্ছ্বাস আসে কী করে? একটা দেশের ৫০ বছরেও একটা হাসপাতাল হয়নি, যেখানে রাষ্ট্রপতি মেডিকেল চেক-আপ করতে পারেন। আমাদের রাষ্ট্রপতির দুটিই প্রধান কাজ। একটি হচ্ছে কিছুদিন পরপর মেডিকেল চেক-আপ, অন্যটি বিভিন্ন সমাবর্তনে গিয়ে একটু হাসি-তামাশা করা। এমন অবস্থার মধ্যে আমরা কী করে গৌরব বোধ করতে পারি?

ঔপনিবেশিক আমলের শিক্ষাদর্শনের সঙ্গে পার্থক্য নেই

আলোচনায় অংশ নিয়ে বাসদের সদস্য ও বাম গণতান্ত্রিক জোটের সমন্বয়ক বজলুর রশীদ ফিরোজ বলেন, ঔপনিবেশিক আমলের শিক্ষাদর্শন ও স্বাধীন বাংলাদেশের শাসকশ্রেণির শিক্ষাদর্শন একই। শোষণমূলক পুঁজিবাদী দেশগুলোও শিক্ষাকে যতটা গুরুত্ব দেয়, গত ৫০ বছরে বাংলাদেশের শাসকগোষ্ঠী শিক্ষার প্রতি ততটা গুরুত্ব না দিয়ে দায়িত্বে অবহেলা করেছে। ক্রমাগত শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ করা হয়েছে এবং হচ্ছে। পাশাপাশি মানুষের গণতান্ত্রিক ও মৌলিক অধিকারগুলো ক্রমাগত সংকুচিত হচ্ছে৷

শিক্ষার নামে সার্টিফিকেট–বাণিজ্য হচ্ছে

বাসদের সদস্য রাজেকুজ্জামান অভিযোগ করে বলেন, আমাদের শিক্ষা গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ ও বিজ্ঞানভিত্তিক হওয়ার কথা থাকলেও তা হয়নি। আমাদের বিজয় হাতছাড়া হয়ে গেছে। স্বাধীনতার পর থেকেই আমাদের যুক্তিহীন শিক্ষার দিকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ডিজিটাল উন্নয়নের নামে আমরা একটা ডিজিটাল প্রতারণার দেশে রয়েছি। এটা হতে পেরেছে, কারণ শিক্ষার মর্মবস্তুটা হারিয়ে গেছে। শিক্ষার নামে সার্টিফিকেট–বাণিজ্য হচ্ছে। শিক্ষার সঙ্গে সংস্কৃতি ও মেধার সঙ্গে মূল্যবোধের বিচ্ছিন্নতা তৈরি করা হয়েছে। শিক্ষার আর্থিক দায়িত্ব রাষ্ট্রকে নিতে হবে। এটা কোনো সুযোগ বা দয়া নয়, এটা অধিকার।

আলোচনা সভায় ছাত্র ফ্রন্টের (বাসদ) লিখিত বক্তব্য তুলে ধরেন সংগঠনের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক নাসির উদ্দীন। ছাত্র ফ্রন্টের সভাপতি আল কাদেরীর সভাপতিত্বে এতে অন্যদের মধ্যে সংগঠনের কেন্দ্রীয় নেতা মুক্তা বাড়ৈ ও শোভন রহমান বক্তব্য দেন।